প্রারম্ভ
তিব্বত
হিমালয়ের চূড়া পেরিয়ে সূয্যিমামা এখনও দেখা দেননি, তবে জেগে উঠেছে হেনরি ওয়াইল্ড। আসলে দুই ঘন্টার বেশি সময় ধরে জেগেই আছে, অপেক্ষা করছে কখন ভোরের সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হবে পাহাড়গুলো।
দুই ঘন্টা জেগে থাকলেও তার এই অপেক্ষা আরও আদিম, মনে মনে ভাবল সে। বছরের পর বছর, জীবনের বেশিরভাগ সময়। ছেলেবেলার কৌতুহল পরিণত হয়েছে নেশায়।
‘নেশা’ শব্দটা ব্যবহার করতে একটু ইতস্তত করল সে। তবে এটাই সত্যি। এই নেশার কারণে অ্যাকাডেমিক জীবনে সইতে হয়েছে অসহ্য বিদ্রুপ আর উপহাস। জীবনভর উপার্জনের অধিকাংশ খরচও হয়েছে এর পেছনে।
তবে নিজেকে মনে করিয়ে দিল হেনরি- এই নেশাই তাকে মিলিত করেছে জীবনের দুই স্মরণীয় নারীর প্রথম জনের সাথে।
‘সূর্যোদয়ের আর কতক্ষণ বাকি?’ লরা ওয়াইল্ড জানতে চাইল। বিশ বছরের বেশি সময় ধরে সংসার করছে হেনরির সাথে, পারকা গায়ে গুটিসুটি মেরে পাশে শোয়া এখন। নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েশনে দু’জনের প্রথম দেখা হয়। ছয় ফুটি হেনরির মাথায় তুষারের মতো সাদা চুল, ওদিকে লরার গাঢ় লালরঙা কেশরাশি দেখলে মনে হত যেন প্রাকৃতিক কিছু না। নিজের নেশার ব্যাপারে একটা রচনা লিখে প্রফেসরের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার পর হেনরি যখন লরার মুখে শুনল- ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি,’ লালচুলো মেয়েটার প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি এক মুহূর্ত।
‘যে কোন সময়,’ হেনরি ঘড়ি দেখে জবাব দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল স্ত্রী-কে। ‘নিনা আমাদের সাথে থাকলে কত ভালো হত।’ নিনা হচ্ছে ওদের মেয়ে, হেনরির জীবনের দ্বিতীয় স্মরণীয় নারী।
‘ওর পরীক্ষার সময় এক্সপেডিশনে এলে তো এমনই হবে,’ লরা ভর্ৎসনা করল।
‘আমাকে দোষ দেয়ার বদলে চাইনিজ সরকারকে দাও। আমি তো পরের মাসেই আসতে চাইছিলাম, কিন্তু ওরা কোন কথা শুনতে নারাজ। হয় এখন নয়তো…’
‘হানি?’
‘কি?’
‘মজা করছিলাম। আমিও সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। তবে হ্যাঁ, নিনা থাকলে আসলেই ভালো হত।’
‘শুলাওডাং থেকে পোস্টকার্ড পাঠালে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ হবে না মনে হয়, তাই না?’ হেনরি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘গোটা পৃথিবীতে একের পর এক গন্তব্যে ওকে নিয়ে ছুটে বেরিয়েছি আমরা, সব ছিল কানাগলি। এখন অবশেষে সত্যিকার একটা সূত্র পেলাম, আর বেচারি আসতেই পারল না!’
‘আমরা ভাবছি যে সূত্রটা সত্যিকারের,’ লরা শুধরে দিল।
‘এক মিনিটের মধ্যেই জানা যাবে সত্যি না মিথ্যা, তাই না?’ সামনের দৃশ্যের দিকে ইঙ্গিত করল হেনরি। আকারে প্রায় সমান, বরফে ঢাকা তিনটা পাহাড়চূড়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওদের ক্যাম্প করা মালভূমির পরে। এখন পাহাড়ের ছায়ার মধ্যে আছে, কিন্তু সূর্য আরেকটু উপরে উঠলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। যেসব গালগল্প একত্রিত করে এখানে আসা, তা যদি সত্যি হয় তাহলে…
উঠে দাঁড়াল হেনরি। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিল তারপর। মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল। প্রবল ঠাণ্ডায় উষ্ণ বাতাস বাইরে বের হয়েই যেন জমে যাবার যোগাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জায়গাটা দশ হাজার ফুটের বেশ উঁচু। বাতাস যেমন পাতলা, তেমনই শীতল। আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতা পায়নি ওরা। তবে শাপে বর হিসেবে এখানকার হাওয়া যে কোন ধরণের দূষণ থেকে মুক্ত। চারদিকে শুদ্ধতার ছাপ।
মনের গভীরে হেনরি বুঝতে পারছে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখানে পূরণ হবে।
ভোরের প্রথম সূর্যালোক পৌঁছে গেছে তিন পাহাড়চূড়ায়।
সবচেয়ে মাঝের পর্বতশৃঙ্গ বাকি দুটোর তুলনায় একটু উঁচু। তাই উজ্জ্বল রোদ সবার আগে ওটার গায়েই হামলা চালিয়েছে। চূড়া পেরিয়ে নামতে থাকল তরল পদার্থের মতো নরম আলো। বাকি দুই পর্বতশৃঙ্গ এখনও ছায়াতে।
‘এ তো সত্যি…’ হেনরি শান্ত গলায় বললেও তাতে মিশে আছে চাপা উত্তেজনা।
লরার কণ্ঠে বিস্ময়ের মাত্রা একটু কম। ‘সোনার পাহাড় বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
স্ত্রীর দিকে ফিরে হাসল হেনরি। তারপর আবার তাকাল সামনে। ‘ওরা ঠিকই বলেছে। হে ঈশ্বর, ঠিক বলেছে ওরা!’
‘একদিক থেকে ব্যাপারটা হতাশাজনক,’ লরা বলল। ‘পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় আগে একদল নাৎসি সর্বপ্রথম এটার কথা জানতে পারে। খুব কাছাকাছি চলেও এসেছিল ওরা।’
‘কিন্তু খুঁজে তো আর পায়নি,’ হেনরি চোয়াল শক্ত করল। ‘আমরা পাব।’
এই সেই সোনার পাহাড়-আজকের আগপর্যন্ত যার অস্তিত্ব ছিল শুধু লোকগাথায়-হেনরির সারা জীবন ধরে একত্রিত করা ধাঁধার সর্বশেষ টুকরো। ওখানে ঠিক কি পাওয়া যাবে, জানা নেই কারও। তবে এটা নিশ্চিত, তা হেনরির লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য…
আটলান্টিস।
*
সোনার পাহাড়ে রোদের খেলা মনে হয় এক মিনিটও টিকল না। তারপর সূর্য উঠে গেল আরও উঁচুতে, পাশের দুই চূড়া উদ্ভাসিত করতে। ততক্ষণে মাঝের পর্বতশৃঙ্গের পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে অভিযাত্রী দলটা।
সাতজন মানুষ আছে দলে। তিন আমেরিকান ও চার তিব্বতি। পরের গ্রুপটাকে ভাড়া করা হয়েছে কুলি আর গাইড হিসেবে। এদিকটা মোটামুটি চেনা থাকলেও, লোকগাথা সত্যি হতে দেখে অতিথিদের মতো আশ্চর্য হয়েছে ওরা। সাধারণত এদিকে তেমন কেউ আসে না। হেনরি বুঝতে পারল একটু আগে যা দেখেছে, সম্ভবত আগে কোন পশ্চিমার চোখে পড়েনি এই দৃশ্য।
শুধুমাত্র যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এসেছে, তাদেরকে ছাড়া।
দলটাকে ডেকে দাঁড় করাল হেনরি। বাকিরা পাথর থেকে তুষার ঝেড়ে বসতে বসতে ও ব্যাকপ্যাক থেকে বের করল চিকন একটা খাতা। প্লাস্টিকের আবরণ দেয়া আছে কাগজগুলোতে।
লরা যোগ দিল স্বামীর সাথে। ‘আবার চেক করছ?’ গলায় কৌতুকের রেশ। ‘ভেবেছি এতদিনে হয়তো মুখস্ত করে ফেলেছ সব।’
‘জার্মান ভাষায় আমি অতটা পোক্ত নই।’ বিশেষ একটা পাতা খুলল হেনরি। সময় আর আবহাওয়ার আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় দাগ পড়েছে ওতে।
হেইনরিখ হিমলারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা জার্মান অ্যান্সেসট্রাল হেরিটেজ সোসাইটি, তথা আহনেনেরবে-র এই গোপন দস্তাবেজ উত্তর জার্মানির উইওয়েলসবার্গ ক্যাসলের এক সেলারের নিচে লুকিয়ে রাখা ছিল। এসএস-এর হেডকোয়ার্টার ছিল উইওয়েলসবার্গ, মিথলজি আর অতিপ্রাকৃতের ব্যাপারে নাৎসি আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধের শেষে এই দুর্গ আর তার মধ্যে সংরক্ষিত সকল জ্ঞান ধ্বংস করে ফেলার আদেশ দেয়া হয়। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ একজন নির্দেশ অমান্য করে সরিয়ে ফেলেছিল কিছু জিনিস।
তারই একটা চলে এসেছে ওয়াইল্ড দম্পতির হাতে।
বার্ন্ড রাস্ট, হেনরির এক পুরনো সহকর্মী এই আবিষ্কারের ব্যাপারে তাকে জানায়। বেশিরভাগ এসএস ডকুমেন্ট চলে গিয়েছিল জার্মান সরকারের হাতে। তবে ওয়াইল্ডদের আগ্রহের ব্যাপারে জানা থাকায় রাস্ট ক্যারিয়ার নষ্টের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে উদ্ধার করে কয়েকটা পৃষ্ঠা- যাতে আটলান্টিসের ব্যাপারে উল্লেখ ছিল। বিক্রেতা পুরনো বন্ধু হলেও যথেষ্ট দাম দিতে হয়েছে জিনিসগুলোর জন্য। তবে হেনরি জানত, পয়সা উসুল হবে।
পাপী নাৎসিদের আবিষ্কারের বদৌলতে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে ভাবলে অস্বস্তি ভর করে হেনরির মনে। এজন্য মেয়েকেও জানায়নি কাগজপত্রগুলোর আসল ঠিকানা। জানে এসব ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব না। অর্ধশতাব্দী আগে এগুলোর মাধ্যমেই নাৎসিরা এই ট্রেইলের শেষ মাথায় পৌঁছে গিয়েছিল।
১৯৩০ সালে আহনেনেরবে তিব্বতে অভিযান শুরু করে। এক দশক পর যখন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ, তখনও থেমে থাকেনি জার্মানদের উঁচু সমাজের এই আগ্রাসন। থুলে সোসাইটির অংশ ছিল ওরা। হিমলার নিজেও তিনবার এশিয়া ঘুরে গেছে। থুলে সোসাইটি বিশ্বাস করত, হিমালয়ের নিচে আটলান্টিয়ানদের বানানো গোপন শহর আছে। জার্মানদের মতো আর্য জাতির মানুষ ছিল ওরা। তবে নিজেদের ওই অভিযান থেকে অভিযাত্রীরা তিব্বতের অনেক ইতিহাস উদ্ধার করতে পারলেও, আটলান্টিয়ানদের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। সবাই জার্মানিতে ফিরেছে খালি হাতে।
কিন্তু এখন হেনরির হাতে থাকা ডকুমেন্টে পাওয়া গেছে চার নম্বর অভিযানের অস্তিত্ব। ব্যাপারটা এমনকি হিটলারের কাছেও গোপন করা হয়েছিল।
অনুসারীদের মতো ফিউরার মিথলজিতে খুব একটা বিশ্বাস করত না। যুদ্ধ বাঁধার পর সে ঠিক করে- অর্ধেক পৃথিবীতে কিংবদন্তীর খোঁজে অভিযাত্রী পাঠিয়ে পয়সা খরচ করবে না, বরং তা ঢালবে নাৎসি ওয়ার মেশিনের পেছনে।
কিন্তু হিমলার ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আহনেনেরবে-র আবিস্কার ততদিনে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে- কিংবদন্তী চলে এসেছে প্রায় হাতের মুঠোয়।
একই ঘটনা ঘটেছে হেনরি আর লরার বেলাতেও, তবে আধা শতাব্দী পর। ডজন ডজন, ক্ষেত্রভেদে শত শত ঐতিহাসিক সূত্র অনুসরণ করে পাওয়া তথ্য একজোট করার পর অবশেষে মিলতে শুরু করে জিগস পাজলের টুকরো। মরক্কোর উপকূলে নিনাকে নিয়ে দশ বছর আগে এক অভিযানে গিয়েছিল ওয়াইল্ড দম্পতি। আফ্রিকান বালুর নিচে পাওয়া যায় প্রাচীন বসতি। তবে দেখা যায় কেউ আগেই হামলা চালিয়েছে ওখানে। দুয়েকটা জিনিস ছাড়া পুরো সাইট লুটেপুটে সাফ।
এখন হেনরি জানে কাজটা কাদের ছিল।
নাৎসিরাও একজোট করতে পেরেছিল পাজলের টুকরো। তারপর অভিযান চালায় মরক্কোতে। আহনেনেরবে-র কিছু দস্তাবেজে আবছাভাবে লেখা আছে ওখানকার আবিস্কারের ব্যাপারে। এজন্য আরেকটা অভিযান পরিচালনা করা হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। ওখানে কি পাওয়া গেছে, তা অবশ্য কোথাও উল্লেখ করা নেই। তবে বলা হয়েছে- ওই মিশন নাৎসিদের পথ দেখিয়ে আনে তিব্বতে, এই সোনালি পাহাড়ে।
এখানে…
‘আমাদের হাতে আরও তথ্য থাকলে ভালো হত,’ হেনরি বলল। ‘দক্ষিণ আমেরিকায় কী পাওয়া গিয়েছিল জানলে খুশি হতাম।’
পাতা উল্টাল লরা। ‘যথেষ্ট পেয়েছি। আমাদের এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ওরা।’ ছাতাপড়া কাগজ থেকে এক লাইন পড়ল ও। ‘দুই কালো পাহাড়ের মাঝে ভোরের রোদ লেগে জ্বলজ্বল করে যে সোনার পাহাড়,’ বলে তাকাল উপরে। ‘ওখানেই পাওয়া যাবে উত্তর।’
‘আপাতত,’ শত-সহস্রবার লেখাটা পড়া থাকা সত্ত্বেও আবার পড়ল হেনরি। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে, অনুবাদে কোন ভুল হয়নি।
আসলেই হয়নি। এই সেই জায়গা।
‘তো প্রবেশপথ থাকার কথা চাঁদের পথের শেষে,’ বাইনোকুলারে চোখ রেখে ঢালটা পরীক্ষা করল হেনরি। পাথর আর তুষার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ‘কিংবদন্তীতে সবসময় এমন ধোঁয়াশাময় নাম কেন থাকে? চাঁদের পথ… কি বুঝব এটা থেকে? চাঁদের দিকে যে পথ গিয়েছে? নাকি চাঁদ যে পথে উদয়-অস্ত যায় সেটা?’
‘আমার ধারনা হচ্ছে পথটা চাঁদের মতো দেখতে,’ লরা বলল। ‘আধখানা চাঁদ।’
‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’ হেনরির চোখে এমন কিছু ধরা পড়ছে না, যা কস্মিনকালে চাঁদের আকৃতির সাথে খাপ খায়।
‘কারণ,’ স্বামীর চোখ থেকে বাইনোকুলার সরিয়ে দিল লরা। ‘এত দূরে নয়, একদম সামনেই দেখতে পাচ্ছি ওটা।’
হেনরি চোখ পিটপিট করল। বুঝতে পারছে না স্ত্রীর কথা। অবশেষে ব্যাপারটা ধরা পড়ল তার নিজের চোখে।
সামনে বাঁকা ও সরু এক দীর্ঘ পথ উঠে গেছে চূড়ার দিকে। ডানে উঠে মিশে গেছে প্রশস্ত এক কার্নিশে। চারদিকে কালো সব পাথরখণ্ড, কিন্তু সরু ওই পথ ছেয়ে আছে সাদা তুষারে। ঠিক যেন আধাআধি চাঁদ। মাটিও অপেক্ষাকৃত মসৃণ ওখানে। আগে কেন দেখেনি, ভেবে অবাক হলো হেনরি।
‘লরা?’
‘হ্যাঁ?’
‘ভাগ্যিস তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, আমি জানি,’ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল ওরা। তারপর চুমু খেল। ‘তো বলো,’ আলাদা হয়ে মুখ খুলল লরা। ‘কত দূর হতে পারে ওটা?’
‘এক মাইল সম্ভবত, পাঁচশো ফুট উপরে। মাত্রাতিরিক্ত ঢালু নয়।’
‘আদ্যিকালের স্যান্ডেল পরে যদি আটলান্টিয়ানরা ওখানে উঠতে পারে, হাইকিং বুট পায়ে দিয়ে আমাদের না পারার তো কারণ নেই।’
‘আমিও তাই ভাবছি।’ পুরনো খাতাটা ব্যাকপ্যাকে ঢোকাল হেনরি। তারপর হাত নেড়ে ইশারা করল দলের বাকিদের উদ্দেশ্যে। ‘চলো সবাই, জীবনের আহ্বানে সামনে এগিয়ে যাই।’
*
যেমন মনে হয়েছিল, চলতে গিয়ে দেখা গেল পথটা তার চেয়ে কঠিন। তুষার ঢাকা জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আলগা নুড়ি। প্রতি পদে পা হড়কানোর ঝুঁকি।
যতক্ষণে কার্নিশে পৌঁছাল ওরা, ততক্ষণে সবচেয়ে উঁচু চূড়া পেরিয়ে গেছে সূর্য। ফলে ছায়া পড়েছে পূর্বদিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দিগন্তে চোখ রাখল হেনরি, একইসাথে শেষ কয়েক কদম পেরোতে সাহায্য করছে স্ত্রীকে। উত্তর দিকে ভারী মেঘ দেখা যাচ্ছে। ওঠার সময় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। অনেকটা নেমে গেছে তাপমাত্রা।
‘বাজে আবহাওয়া?’ লরা স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করল।
‘তুষাড়ঝড় আসছে মনে হয়।’
‘ভালো। শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছে গেছি।’ পেছন ফিরে কার্নিশটা দেখল লরা। সবচেয়ে চিকন অংশটাও দশ-বারো গজ প্রশস্ত। ‘এখানে ক্যাম্প করলে সমস্যা হওয়ার কথা না।’
‘আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগে গাইডদের বলো তাঁবু ফেলতে,’ হেনরি বলল। সোজা পথের এখানেই সমাপ্তি। কার্নিশের পর থেকে ওঠার জন্য ক্লাইম্বিং গিয়ার লাগবে। সেটা কোন সমস্যা না। সবকিছু ওদের সাথে আছে। তবে যদি আহনেনেরবে-র কাগজপত্র সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এসবের দরকার পড়বে না…
তিব্বতিদের নির্দেশ দিয়ে স্বামীর কাছে ফিরল লরা। ‘তুমি কী করতে যাচ্ছ?’
‘একটু ঘুরে দেখি আশেপাশে। যদি গুহায় ঢোকার মতো কোন প্রবেশমুখ থাকে, খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না।’
লরা ভ্রুকুটি করল। সবুজ চোখে গভীর দৃষ্টি। ‘তাহলে ওদের তাঁবু ফেলতে বললে কেন?’
‘এজন্যই তো টাকা দিয়েছি।’ কাছের পাথরে একা বসে থাকা একজনের দিকে ফিরল হেনরি। ‘তোমার খবর কি, জ্যাক? আসতে চাও?’
দলের তৃতীয় আমেরিকান সদস্য পারকার হুডের নিচ থেকে উঁকি মারল। ‘দম ফিরে পেতে দাও একটু, হেনরি। মনে হয় আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করাই ঠিক হবে। পানি ফুটলে একটু কফি ঢালব গলায়।’
‘এই তিব্বতে এসেও ক্যাফেইনের নেশায় বাধা পড়েনি, হাহ?’ জ্যাককে পেছনে ফেলে স্বামী-স্ত্রী আগে বাড়ল। ‘এত বছর ধরে বলে আসছে, আমরা নাকি আটলান্টিস খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি। তারপর যখন ভালো একটা সূত্র পেলাম, সাথে আসার জন্য উতলা হয়ে গেল। আর অবশেষে দরজায় কড়া নাড়ছি, এমন সময় কফি বিরতি চাই!’ হেনরি বলল। কয়েক মিনিট চলার পর থামল ও। তাকিয়ে রইল সামনের পাথরের দিকে।
‘কিছু পেলে?’ লরা জানতে চাইল।
‘এই পাথরগুলো…’ সামনে ইঙ্গিত করল হেনরি। বহু বছর আগে, ইন্ডিয়ান আর এশিয়ান টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে ভেঙেচুড়ে উপরদিকে উঁচু হয়েছে ভূখণ্ডের স্তর। ফলাফল হিসেবে জন্ম নিয়েছে হিমালয় পর্বতমালা।
‘কী হয়েছে এগুলোর?’
‘এই পাথরগুলো সরিয়ে দিতে পারলে,’ হেনরি একটা স্তূপের দিকে ইশারা করল। ‘হয়তো প্রবেশপথ পাওয়া যাবে।’
পাথরের ভাঁজে একফালি কালো অন্ধকার লক্ষ্য করল লরা। ‘ঢোকার মতো বড়?’
‘দেখা যাক,’ স্তূপের উপরের পাথর সরাতে থাকল হেনরি। ফলে বড় হলো কালো মুখ। ‘হাত লাগাও আমার সাথে।’
‘ওহ, স্থানীয়দের তাঁবু পাতার জন্য পয়সা দিচ্ছ। আর ভারী পাথর সরানোর বেলায় মনে পড়ে বউয়ের কথা…’
‘নিশ্চয়ই ভূমিধ্বস হয়েছিল। এটা প্রবেশপথের উপরদিক।’ আরও পাথর সরাতে থাকল হেনরি। লরা সাহায্য করল। ‘ফ্ল্যাশলাইট কাজে লাগাও, দেখো শেষ মাথা দেখা যায় কি না।’
ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগলাইট বের করে আনল লরা। জ্বালিয়ে তাক করল গর্তে। ‘তলা দেখতে পাচ্ছি না।’ তার চিৎকার করা কণ্ঠের প্রতিধ্বনি এল ভেতর থেকে। হেনরি চমকে উঠল। ‘ওহ, দুঃখিত।’
‘জায়গাটা বেশ বড়,’ বলে উঠল হেনরি তারপর। ‘তোমার মুখের মতো প্রায়।’
স্বামীর মাথার পেছনে আলতো হাতে চাপড় বসাল লরা।
‘এই পাথরটা সরিয়ে দিতে পারলে হয়তো কোনমতে ঢুকতে পারব।’ হেনরি বলল।
‘মানে আমি হয়তো ঢুকতে পারব।’
‘অবশ্যই, লেডিজ ফার্স্ট।’
‘এত সৌজন্য দেখাতে হবে না,’ লরা কৌতুক করল। তারপর একসাথে দু’জন মিলে আঁকড়ে ধরল পাথরটা। শুরুতে কিছু হলো না, তারপর সম্মিলিত টানের মুখে পিছু হটল ভারী প্রস্তরখণ্ড। দেখা গেল সদ্য উনুক্ত হওয়া খোলা মুখটা প্রায় তিন ফুট লম্বা, আর চওড়ায় এক ফুট।
‘ঢুকতে পারবে তো?’ হেনরি জানতে চাইল।
এক হাত ঢুকিয়ে লরা গুহার নিচটা পরখ করল। ‘ভেতরে চওড়া হয়েছে। একবার ঢুকে গেলে সমস্যা হবে না আশা করি।’ নিচু হয়ে ফ্ল্যাশলাইট তাক করল তারপর। ‘ভূমিধ্বসের ব্যাপারে তোমার কথাই ঠিক। বেশ ঢালু জায়গা।’
‘তোমার গায়ে দড়ি বেঁধে দিচ্ছি,’ ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল হেনরি। ‘সমস্যা হলে টেনে তুলে নিতে পারব তাহলে।’
ক্লাইম্বিং হার্নেস বাঁধা হলে চুলে পনিটেইল করল লরা। তারপর পা আগে দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহায় দাঁড়ানোর পর মনে হলো যেন জুতোর নিচ থেকে সরে যাচ্ছে ঢিলে হয়ে যাওয়া নুড়ি।
‘কী দেখছ?’ হেনরি জানতে চাইল।
‘যতদূর চোখ যায় শুধু পাথর।’ আবছায়াতে লরার চোখ সয়ে আসছে আস্তে আস্তে। আবার জ্বালতে হলো ম্যাগলাইট। ‘নিচে সমতল মেঝে। মনে হয়…’ আবার লাইট উঁচু করল ও। পাথুরে দেয়ালে আলো পড়ছে। ‘এখানে একটা প্যাসেজওয়ে আছে। বেশ প্রশস্ত। জানি না কতদূর গিয়েছে। লম্বা পথ হতে পারে।’ কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘মনে হচ্ছে মানুষের হাতে তৈরি!’
‘নিচে নামতে পারবে?’
‘চেষ্টা করছি।’ পরীক্ষামূলকভাবে এক পা আগে বাড়ল লরা। দুই হাত তুলে রেখেছে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। স্তূপ থেকে টলমল করছে আলগা পাথরের গুঁড়ো। ‘খুব নরম মনে হচ্ছে। আমাকে সম্ভবত…’
কড়মড় আওয়াজে ডান পায়ের নিচ থেকে একটা পাথরের টুকরো সরে গেল। তাল সামলাতে না পেরে পিঠে ভর দিয়ে পড়ল লরা, গড়াতে গড়াতে চলল ঢাল বেয়ে। নাচছে ফ্ল্যাশলাইটের আলো।
‘লরা! লরা!’
‘আমি ঠিক আছি! পা ফসকে গিয়েছিল।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মহিলা। মোটা কাপড় গায়ে থাকায় হাত-পা কেটে-ছড়ে যায়নি।
‘টেনে তুলে আনব নাকি?’
‘না না। ঠিক আছি আমি। চলেই যখন এসেছি, আশেপাশে দেখে যাই।’ ছিটকে পড়ে যাওয়া লাইটটা হাতে নিল লরা…
আর সাথে সাথে বুঝতে পারল, এখানে সে একা নয়।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল মহিলা। ভয়ের চেয়ে ধাক্কা খেয়েছে বেশি। তারপর মনে জায়গা করে নিল কৌতূহল। আশেপাশে আলো ফেলে দেখতে লাগল চারপাশের দৃশ্য।
‘হেনরি?’ স্বামীকে ডাকল এক মুহূর্ত পর।
‘কি?’
‘মনে আছে সেই গোপন নাৎসি অভিযানের কথা? তিব্বতে আসার পর আর তাদের কোন হদিস পায়নি কেউ।’
‘হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়।’ কৌতুকের ছলে চেঁচিয়ে জানাল হেনরি। ‘কেন?’
লরার কণ্ঠে বিজয়ের উল্লাস। ‘মনে হয় আমি ওদের খুঁজে পেয়েছি।’
*
গুহায় পাঁচটা লাশ। শীঘ্রই বোঝা গেল, পাথর ধ্বসে মৃত্যু হয়নি তাদের। সম্ভবত হিমালয়ের প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মরেছে হতভাগারা। একই কারণে শুকিয়ে মমির মতো হয়ে আছে লাশগুলো। অভিযাত্রী দলের বাকিরা গুহা ঘুরে দেখতে দেখতে মৃতদেহগুলোর দিকে মন দিল ওয়াইল্ড দম্পতি।
‘সম্ভবত খারাপ হয়ে গিয়েছিল আবহাওয়া,’ হেনরি বলল। বৈদ্যুতিক লন্ঠনের আলোয় দেখছে লাশগুলো। ‘তাই এখানে এসে আশ্রয় নেয়। আর বাইরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।’
‘ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু, আমি কখনও এভাবে মরতে চাই না,’ লরা মুখ বিকৃত করল।
তিব্বতি গাইডদের একজন, সোনাম, প্যাসেজের সামনে থেকে ডাকল এমন সময়। ‘প্রফেসর ওয়াইল্ড! এখানে আরও কিছু আছে।’
মৃতদেহ ছেড়ে গুহা ধরে আগে বাড়ল ওরা। লরা যেমনটা ভেবেছিল, এদিকটা আসলেই মানুষের হাতে তৈরি। পাথর কুঁদে বানানো হয়েছে। ত্রিশ ফুটের মতো দূরে, দলের বাকিদের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখা গেল পথের শেষ মাথায় কি আছে।
একটা মন্দির… কিংবা সমাধি।
আয়তাকার চেম্বারের মাঝখানে বেদির মতো জায়গাটা পরীক্ষা করছে জ্যাক। ‘তিব্বতি নয়,’ ওয়াইল্ড দম্পতিকে এগোতে দেখে ঘোষণা করল ও। ‘পাথরের লেখাগুলো গ্লোযেল বা এই ধরণের কোন ভাষা।’
‘গ্লোযেল?’ হেনরির গলায় বিস্ময় আর উচ্ছ্বাসের মিশ্রণ। ‘আমি সবসময় বলে আসছি, আটলান্টিয়ানরা এমন ভাষা ব্যবহার করত।’
‘কে জানে কি করত না করত।’ দেয়ালে আলো ফেলল লরা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কলামে শিলালিপি খোদাই করা। তির্যক ভাবে লেখা হয়েছে অক্ষরগুলো। দেখে মনে হয় বিশেষ কোন কারণ আছে। নাৎসিরা একেবারে জায়গামতো চলে এসেছিল, ভাবল মহিলা। অ্যালবার্ট স্পিয়ার এই স্থাপত্য অনুসরণ করত।
কলামের মধ্যে মানুষের অবয়ব আছে। সবচেয়ে বড়টার কাছে ঘেঁষল হেনরি। অন্যগুলো অপরিচিত ঠেকলেও বুঝতে বেগ পেতে হলো না এটা কার দেহাবয়ব।
‘পসেইডন…’ বিড়বিড় করল ও।
লরা যোগ দিল স্বামীর সাথে। ‘হে ঈশ্বর, এটা তো পসেইডন!’ গড়পড়তা গ্রিক কাঠামোর মতো না হলেও, আকৃতিটার ডান হাতে ধরা ত্রিশূল ভুল করার মতো নয়।
‘ভালো,’ জ্যাক বলল। ‘মি. ফ্রস্ট জেনে খুশি হবেন যে এই অভিযান সফল…’
‘ফ্রস্ট চুলায় যাক,’ লরা ঘোঁত করে উঠল। ‘এটা আমাদের আবিষ্কার। ও শুধু ফান্ড দিয়ে সাহায্য করেছে।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা,’ স্ত্রীর কাঁধে চাপড় দিল হেনরি। ‘লোকটাকে অন্তত ধন্যবাদ দিতে হবে। তার জন্যই আমাদের গাড়ি বিক্রি বা মেয়ের কলেজ ফান্ডে হাত দেয়ার সিদ্ধান্তে যেতে হয়নি।’ বলে আশেপাশে তাকাল সে। ‘সোনাম, আর কিছু আছে এখানে? কোন রুম বা প্যাসেজ?’
‘না,’ সোনাম জবাব দিল। ‘এটাই শেষ মাথা।’
‘ওহ,’ লরার হতাশ গলা। ‘এই তাহলে সব? মানে আবিষ্কারটা ভালো, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম আর কিছু…’
‘হয়তো আরও কিছু আছে,’ হেনরি সান্ত্বনা দিল। ‘কার্নিশ ধরে আরও সমাধি থাকতে পারে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।’
প্যাসেজ ধরে লাশগুলোর সামনে ফিরল সে। লরা আর জ্যাক অনুসরণ করল। নাৎসিদের পরনে অনেক বছর আগের শীতের পোষাক। শূন্য অক্ষিকোটর তাকিয়ে আছে কুঁচকানো চামড়ার ভেতর থেকে। ‘হয়তো এদের মধ্যে ক্রাউস আছে।’
‘ওই যে,’ লরা একটা লাশের দিকে ইঙ্গিত করল। ‘অভিযাত্রী দলের নেতা।’
‘তুমি কীভাবে জানলে?’
লাশটার দিকে গ্লাভপরা আঙুল উঁচু করল মহিলা। প্রায় বুক স্পর্শ করছে। লন্ঠন এগিয়ে এনে হেনরি লক্ষ্য করল, ওখানে ছোট্ট একটা ধাতব ব্যাজ আটকানো।
সাথে সাথে বরফশীতল একটা স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। শাটযস্টাফেল বা এসএস-এর ইনসিগনিয়া এটা। অর্ধশতক আগে মুছে ফেলা হয়েছে ওই সংস্থার অস্তিত্ব। তাও নামটা এখনও ভয় জাগানিয়া।
‘ইয়র্গেন ক্রাউস,’ লাশটার দিকে ঝুঁকল হেনরি। নিয়তির কি নির্মম খেল! অভিযানে এসে এসএস ইনসিগনিয়ার মতো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে নাৎসি দলনেতার নিজের করোটি। ‘কখনও ভাবিনি তোমার সাথে দেখা হবে। কিন্তু কোন সে জিনিস, যা তোমাকে এখানে টেনে আনল?’
‘খুঁজে দেখতে দোষ কি?’ লরা বলল। ‘ওই তো ওর প্যাক। ভেতরে হয়তো নোটবুক রয়েছে। দেখে নেয়া যাক।’
‘দাঁড়াও, আমাকে এই কাজ করতে বলছ?’
‘অবশ্যই। মরা নাৎসিদের জিনিসে আমি হাত দেব না।’
‘জ্যাক?’
মাথা নাড়ল জ্যাক। ‘অনেক পুরনো লাশ ঘেঁটেছি। কিন্তু এই পাপীদের ধরব না।’
‘হুশ,’ হেনরি হেসে ফেলল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলগোছে তুলে নিল লাশের ব্যাগ, চেষ্টা করছে যথাসম্ভব কম বিরক্ত করতে।
প্রথমে বের হলো গতানুগতিক জিনিস- ফুলে ওঠা জংপড়া ব্যাটারিওয়ালা ফ্ল্যাশলাইট, গ্রিজপ্রুফ পেপারে মোড়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ইত্যাদি। এরপর এল আগ্রহ জাগানিয়া ব্যাপার- ভাঁজ করা ম্যাপ, চামড়ায় বাঁধানো নোটবুক, গ্লোযেল লিপিওয়ালা কাগজ, ম্যাপ বা চার্ট খোদাই করা একটা তামার পাত… তারপর কালো ভেলভেটে মোড়ানো কিছু একটা।
তামার টুকরোটা হাতে নিল লরা। ‘বালুর ঘসায় ক্ষয়ে গেছে। মরোক্কোর জিনিস নাকি?’
‘হতে পারে,’ হেনরি জবাব দিল। সবার আগে নোটবুকগুলো পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু তার মন তামার পাতের উপর। এক ফুটের কম লম্বা ওটা, আশ্চর্যজনকভাবে ভারী। লন্ঠনের পাশে ওটা রেখে আলতো হাতে ভেলভেট সরাল হেনরি।
‘এটা কী?’ লরা জানতে চাইল।
‘কে জানে, ধাতব কিছু মনে হচ্ছে।’ সময় আর ঠাণ্ডার প্রকোপে শক্ত হয়ে আছে ভেলভেট। শেষ পরতটা খোলায় বেশ বেগ পেতে হলো হেনরিকে।
‘ওয়াও,’ লরার মুখ হাঁ হয়ে গেল। জ্যাকের চোখও বিস্ময়ে ছানাবড়া।
ভেলভেটের ভেতর থেকে বের হলো ইঞ্চি দুয়েক চওড়া একটা ধাতব পাত। একমাথা গোল, তীরের ফলা খোদাই করে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। লন্ঠনের শীতল নীলচে আলোতেও লালচে-সোনালি আভা ছড়াচ্ছে জিনিসটা। প্রকৃতিতে এমন কিছু পাওয়া অসম্ভব।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেনরি হাঁটু গেড়ে বসল ভালো করে দেখার জন্য। লরার হাতে ধরা জিনিসটাতে সময় বা আবহাওয়া কোন আঁচড় কাটতে পারেনি। যেন এই মাত্র পালিশ করে আনা। ধাতুটা সোনা বা ব্রোঞ্জ না, কিন্তু…
সামনে ঝুঁকেছে লরাও। তার নিঃশ্বাস পড়ছে ধাতুর টুকরোটার উপর। ‘আমি যা ভাবছি, এটা কি তাই?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। হে ঈশ্বর! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নাৎসিরা অরিচালকামের তৈরি আর্টিফ্যাক্ট খুঁজে পেয়েছিল, ঠিক যেমনটা বর্ণনা করে গেছেন প্লেটো। সত্যিকারের আটলান্টিয়ান আর্টিফ্যাক্ট! তাও পঞ্চাশ বছর আগে!’
‘বাড়ি ফিরে নিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও,’ লরা ফোড়ন কাটল। ‘ও সবসময় ভেবে আসছে, মরোক্কোতে পাওয়া জিনিসটা আসল অরিচালকাম।’
‘তাই করতে হবে মনে হয়,’ হেনরি সাবধানে টুকরোটা উঁচু করল। ‘এটা রঙচটা ব্রোঞ্জ হতেই পারে না।’ ও লক্ষ্য করল নিচের দিকটা সমান নয়। চৌকো অংশে বৃত্তাকার একটা ভাগ আছে। ঠিক তার উল্টোদিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে তৈরি খাঁজ। ‘বড় কিছুর অংশ হতে পারে,’ পরীক্ষা করে বলল হেনরি। ‘যেন কোথাও ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল।’
‘কিংবা দুলতো,’ লরা প্রস্তাব করল। ‘পেন্ডুলামের মতো।’
তীর চিহ্নের উপর আঙুল বোলাল হেনরি। ‘কোথাও দিকনির্দেশ করত নাকি?’
‘এই চিহ্নগুলো কীসের?’ জ্যাক জিজ্ঞেস করল। জিনিসটার দৈর্ঘ্য বরাবর সরু একটা রেখা আছে, প্রতি পাশে সারবাঁধা চিহ্ন ঝাপসা হয়ে গেছে। ছোট ছোট বিন্দু, প্রতি সারিতে আটটা করে। এছাড়াও…
‘আরও গ্লোযেল হরফ,’ হেনরি বলল। ‘কিন্তু সমাধিতে থাকা লিপির মতো না। দেখো, অনেকটা হায়ারোগ্লিফের মতো।’
আরও কাছে ঘেঁষল জ্যাক। ‘অলমেক মনে হচ্ছে, অথবা ওরকম কিছু। অগোছালো মিশ্রণ…’
‘এসবের মানে কী?’ লরা জানতে চাইল।
‘জানি না। এই ভাষায় আমি দক্ষ নই। অন্তত এখন পর্যন্ত না।’
‘মনে হচ্ছে জিনিসটা বানানোর পর যোগ করা হয়েছে লেখাগুলো,’ হেনরি যোগ করল। ‘তীর চিহ্নের তুলনায় খোদাই করা লিপি অনেক এবড়োখেবড়ো।’ জিনিসটা ভেলভেটে রাখল সে। ‘আমাদের অভিযান সফল হওয়ার প্রমাণ এটা।’ বলে জড়িয়ে ধরল লরাকে। ‘আমরা পেরেছি! প্রমাণ করতে পেরেছি, আটলান্টিস শুধু এক কাল্পনিক কিংবদন্তী নয়।’
স্বামীকে চুমু খেল লরা। ‘এবার শুধু খোদ আটলান্টিস খুঁজে বের করার পালা, তাই না?’
‘হ্যাঁ। প্রতিবার একটা করে ধাপ টপকানো।’
গুহার ভেতর থেকে চিৎকার ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করল। ‘এখানে কিছু আছে, প্রফেসর!’ সোনামের গলা।
আর্টিফ্যাক্টটা মেঝেতে রেখে তিব্বতি গাইডের সাথে যোগ দিল হেনরি ও লরা। ‘এটা দেখুন,’ সোনাম বলল। সমাধির দেয়ালে আলো তাক করে রেখেছে। ‘ভেবেছিলাম পাথরের ফাটল, তারপর বুঝলাম অন্য কাহিনী।’ এক হাতের গ্লাভ খুলে পাথুরে ফাটলে আঙুল বোলাল সে। ‘পুরোটা জুড়ে একই রকম পুরুত্ব। আর ওখানে এমন আরেকটা আছে।’ প্রায় নয় ফুট সামনে ইঙ্গিত করল তারপর।
‘দরজা?’ লরা জানতে চাইল।
ফাঁকটা অনুসরণ করল হেনরি। ফ্ল্যাশলাইটের আলো উঠে যাচ্ছে মেঝে থেকে আট ফুট উপর পর্যন্ত। ‘বেশ বড় দরজা। জ্যাককে দেখাতে হবে।’ বলে গলা উঁচু করল সে। ‘জ্যাক? কোথায় তুমি? জ্যাক!’ প্রতিধ্বনি ছাড়া কোন জবাব এল না। ‘গেল কোথায়!’
লরা মাথা নাড়ল। ‘প্রস্রাব করতে যাওয়ার আর সময় পেল না? এই শতাব্দীর সবচেয়ে আর্কিওলজিক্যাল আবিষ্কার ফেলে…’
‘প্রফেসর ওয়াইল্ড!’ অন্য এক তিব্বতি ডাকল। ‘বাইরে কিছু একটা আছে! শুনুন!’
চুপ হয়ে গেল সবাই। নিঃশ্বাস ছাড়তেও ভুলে গেছে যেন। ক্রমে কাছিয়ে আসছে ধুপ ধুপ আওয়াজ। বাতাস কাটার শব্দ এটা।
‘হেলিকপ্টার?’ লরার গলায় অবিশ্বাস। ‘এখানে?’
‘এসো,’ হেনরি ডাকল। ছুটতে শুরু করেছে প্রবেশপথের দিকে। কালো হয়ে গেছে বাইরের আকাশ। দড়ি বেয়ে উঠে গেল তারপর পাথুরে স্তূপের মাথায়।
‘চাইনিজ মিলিটারি?’ লরা জানতে চাইল।
‘ওরা কীভাবে জানবে আমরা কোথায়? এমনকি আমরা নিজেরাও তো জানতাম না শুলাওডাং ছাড়ার পর কোনদিকে যাচ্ছি।’ ফোকর পেরিয়ে কার্নিশে পা রাখল হেনরি। অনেক খারাপ হয়ে গেছে আবহাওয়া। বাতাসের তুমুল গতি…
তবে এটা তার চিন্তার প্রধান কারণ নয়। হেলিকপ্টারটা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাল হেনরি। আওয়াজ শোনা গেলেও বাহনটা চোখে পড়ছে না।
জ্যাককেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
লরা এগিয়ে এল পেছনে। ‘কোথায় ওটা?’
এক মুহূর্ত পর যান্ত্রিক ফড়িং নিজেই দৃষ্টিসীমায় উদয় হয়ে জবাব দিল প্রশ্নের।
চাইনিজ না, হেনরি সাথে সাথে বুঝতে পারল। কোন লাল তারকা চিহ্ন নেই। আসলে কোন চিহ্নই নেই। টেইল নাম্বারের জায়গাও খালি। পুরো গায়ে কালচে ধূসর রঙ স্পেশাল ফোর্সের পরিচয় বহন করছে। এরা কারা?’
বাহনটার পরিচয় বোঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান হেনরির নেই। তবে এটা পরিষ্কার, প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টে বেশ কিছু লোক আঁটবে। ককপিটের কাচের পেছনে দুই পাইলটকে দেখা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে ওরা, যেন খুঁজছে কাউকে।
ওদেরকে…
‘গুহায় ফিরে যাও!’ লরার উদ্দেশ্যে চেঁচাল হেনরি। চিন্তিত হলেও স্বামীর আদেশ মানল মহিলা। ঢুকে গেল অন্ধকারে।
কাছে চলে এসেছে হেলিকপ্টার। রোটরের বাতাসের চাপে বরফকুচি উড়ছে বাতাসে। পিছিয়ে গুহামুখে চলে এল হেনরি।
হঠাৎ এক পাইলট দেখে ফেলল ওকে, হাত তুলে ইশারা করল সঙ্গীকে দেখানোর জন্য।
বিরাট কোন এলিয়েন পতঙ্গের মতো ঘুরে গেল হেলিকপ্টার। চোখের মতো ককপিটের জানালা ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার পাশ ফিরল। একটা দরজা খুলে গেল ওদিকে। সাপের মতো দুই কয়েল দড়ি নেমে এসে পড়ল মাটিতে।
কালো কাপড়ে গা ঢাকা একজোড়া অবয়বকে দেখা গেল দড়ি বেয়ে নামতে। হেনরি লক্ষ্য করল, উভয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। পিঠ থেকে ঝুলছে অটোমেটিক রাইফেল।
অভিযাত্রী দলের কাছে একমাত্র অস্ত্র বলতে আছে সাধারণ হান্টিং রাইফেল। বুনো পশু তাড়ানোর জন্য আনা। তাও সাথে থাকলে কাজ হত। জিনিসটা রেখে আসা হয়েছে নিচের ক্যাম্পে।
অস্ত্রধারীরা মাটি স্পর্শ করতে না করতে আরেক জোড়াকে দেখা গেল নামার প্রস্তুতি নিতে। ওদের পিঠেও রাইফেল ঝুলছে।
ফোকর পেরিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল হেনরি। মেঝেতে পা রাখল দুম করে।
‘হেনরি?’ ডাকল লরা। ‘কী হচ্ছে এসব?’
‘বন্ধুভাবাপন্ন মনে হচ্ছে না ওদের,’ বিরসবদনে জবাব দিল হেনরি। ‘অন্তত চারজন আছে, সাথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র।’
‘হে ঈশ্বর! জ্যাকের কী হলো?’
‘জানি না। ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমাদের ওই দরজা খুলতে হবে। এসো।’ লাশের পাস থেকে আর্টিফ্যাক্টটা তুলে নিল হেনরি। তারপর ভেলভেটে জড়িয়ে রওনা দিল সমাধির উদ্দেশ্যে।
ওদিকে চার তিব্বতি মিলে খুঁজে দেখেছে সব। ‘এখানে কিছু নেই,’ প্রফেসরকে এগোতে দেখে জানাল একজন।
‘অবশ্যই আছে,’ হেনরি চেঁচিয়ে বলল। ‘কোন রিলিজ, কি-হোল, যে কোন কিছু!’ পেছন ফিরতে দেখা গেল, একজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে গুহামুখে। এক মুহূর্ত পর উধাও, যেন গুহা গিলে নিয়েছে। তারপর আরেকজন, আরেকজন… ‘ধুশ শালা! ভেতরে ঢুকে পড়ছে!’
লরা স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল। ‘হেনরি!’
পাঁচজন মানুষ, সবাই সশস্ত্র।
ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা।
লাল আলোর রেখা নাচছে অন্ধকারে। লেযার সাইট। পেছনে হ্যালজেন ফ্ল্যাশলাইটের বিম। আগুপিছু করে প্যাসেজ হয়ে সামনে বাড়ছে অস্ত্রধারীদের দল।
হেনরি জায়গায় জমে গেল। আলো চোখে পড়ায় সাময়িকভাবে অন্ধ। বুঝতে পারছে না কী করবে। পালানোর পথ নেই। শরীরে কাঁপতে থাকা লেযার ডট বলে দিচ্ছে, সেই চেষ্টা করতে গেলে…
‘প্রফেসর ওয়াইল্ড!’
বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল হেনরির মুখ। লোকগুলো ওর নামও জানে!
‘প্রফেসর ওয়াইল্ড?’ আবার ডাকল কণ্ঠের মালিক। ভরাট গলা। আঞ্চলিক টান আছে। গ্রিক নাকি? ‘যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আপনিও, মিসেস ওয়াইল্ড।’ ক্রমে এগিয়ে আসছে সামনে।
‘আপনারা কে?’ হেনরি জানতে চাইল। ‘কী চান?’
ফ্ল্যাশলাইট ধরা মানুষগুলো থামল। একজন এগিয়ে এল অভিযাত্রী দলের দিকে। ‘আমার নাম জিওভান্নি কোবরাস।’ সমাধিতে প্রতিফলিত হওয়া আলোর সাহায্যে লোকটার অবয়ব বুঝতে পারছে হেনরি। রোমান ধাঁচের শক্তপোক্ত, তীক্ষ্ম চেহারা। কপালের উপর থেকে কালো চুল খুলি কামড়ে পেছনে ছড়িয়ে আছে। ‘আমি যা চাই… বলতে আফসোস হচ্ছে- আপনাদের।’
লরার চোখে বিস্ময়ের দৃষ্টি। ‘মানে?’
‘মানে আপনাদেরকে আর এই অনুসন্ধান চালাতে দেয়া হবে না। মাফ চাইছি, এতে দুনিয়ার উপর কঠিন বিপর্যয় নেমে আসবে।’ মাথা নত করল কোবরাস। তারপর এক পা পিছিয়ে গেল। ‘ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ নেই আমার।’
হেনরি আর লরার উপর স্থির হলো লেযার লাইট।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলল হেনরি। ‘দাঁড়ান…’
গুহার নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজে।
প্রতিধ্বনি থামার জন্য অপেক্ষায় রইল কোবরাস, তাকিয়ে আছে গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছয়টা লাশের দিকে। তারপর চটজলদি নির্দেশ দিল বাকিদের। ‘অভিযানের সাথে সম্পৃক্ততা আছে এমন জিনিসপত্র সরিয়ে নাও- ম্যাপ, নোট, ইত্যাদি সবকিছু। আর ওখানকার লাশগুলোর ক্ষেত্রেও একই কাজ করবে।’ বলে ইঙ্গিত করল নাৎসি মৃতদেহগুলোর দিকে। ‘ওটা সম্ভবত ক্রাউসের দল। ইতিহাসের একটা রহস্য অবশেষে সমাধান হলো।’
‘জিওভান্নি,’ এক অস্ত্রধারী ডাকল হেনরির লাশের উপর ঝুঁকে পড়ে।
‘কী হয়েছে, ইউরি?’
‘দেখো তো একটু।’
কোবরাস এগিয়ে গেল। ‘হে ঈশ্বর!’
‘এটা অরিচালকাম, তাই না? ইউরি ভোলগান জিজ্ঞেস করল। এইমাত্র মোড়ক খুলে বের করা জিনিসটার গায়ে টর্চের আলো ফেলছে। চমকাচ্ছে উজ্জ্বল কমলারঙা আর্টিফ্যাক্ট।
‘হ্যাঁ, তবে আমি আগে এমন কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্টিফ্যাক্ট নিজের চোখে দেখিনি। শুধু ভাঙাচোরা দেখেছি।’
‘সুন্দর… কপাল খুলে যাবে, কী বলো? মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হবে এটার।’
‘তা হবে,’ জিনিসটার উপর সেঁটে আছে কোবরাসের চোখ। সোজা হয়ে দাঁড়াল একটু পর। ‘তবে এটা লুকিয়ে রাখতে হবে।’ একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে সমাধির দেয়াল পরীক্ষা করল অস্ত্রধারীদের দলনেতা। প্রাচীন দেবতাদের চিত্র ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ‘গ্লোযেল… তবে আটলান্টিস নিয়ে কিছু নেই।’
‘হয়তো আমাদের পুরো সমাধি খুঁজে দেখা উচিত,’ ভোলগান প্রস্তাব দিল। শেষবারের মতো দেখে নিয়ে ভেলভেটে মুড়িয়ে রাখছে প্রাচীন আর্টিফ্যাক্ট।
ভেবে দেখল কোবরাস। ‘না,’ জবাব দিল অবশেষে। ‘কিছু নেই এখানে। লুট হয়ে গেছে সম্ভবত। আমি আসলেই ভেবেছিলাম ওয়াইল্ডরা আটলান্টিসের ট্রেইল ধরে আমাদের সামনে এগিয়ে নেবে। কিন্তু এটা আরেকটা কানাগলি ছাড়া আর কিছু না। ঝড় আসার আগে বেরিয়ে যেতে হবে।’ বলে ঘুরে এগোতে শুরু করল প্রবেশপথের দিকে।
পেছনে ভোলগান ইতিউতি তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, কেউ তাকে দেখছে না। তারপর কাপড়ে মোড়া আর্টিফ্যাক্টটা চালান করে দিলে জ্যাকেটের পকেটে।
*
কার্নিশের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে কোবরাস, ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে চক্কর কাটতে থাকা হেলিকপ্টারকে সংকেত দিচ্ছে। কাজ সেরে পেছন ফিরে তাকাল ক্যাম্পের সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। ‘তুমি ঠিক কাজই করেছ।’
হুডের নিচে ঢাকা পড়েছে জ্যাকের চেহারা। ‘এজন্য আমি গর্বীত নই। ওরা আমার বন্ধু ছিল। বাচ্চা মেয়েটারই বা কী হবে?’
‘এটাই নিয়তি,’ কোবরাস জবাব দিল। ‘ব্রাদারহুড কখনও চাইবে না আটলান্টিস খুঁজে বের করা হোক। বিশেষ করে ওই ক্রিস্টিয়ান ফ্রস্ট যেন সফল না হয়। ওয়াইল্ডদের মতো অভিযাত্রীদের ফান্ড দিচ্ছে ব্যাটা। জানে আমরা নজর রাখছি তার উপর।’
‘যদি ফ্রস্ট বুঝতে পারে, আমি তোমাদের হয়ে কাজ করছি?’ জ্যাক নার্ভাস গলায় জানতে চাইল।
‘ওকে বোঝাবে পুরো ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা। শুলাওডাং-এর দশ কিলোমিটার আগে তোমাকে নামিয়ে দেব হেলিকপ্টার থেকে। এতে আমাদের সাথে কেউ দেখে ফেলার ঝুঁকি কমবে। গ্রামে ফিরে ফ্রস্টের সাথে যোগাযোগ করবে এরপর। বলবে অ্যাভালাঞ্চ থেকে তুমিই একমাত্র বেঁচে ফিরতে পেরেছ। তুষারঝড়, পাথরধ্বস… যা বলতে মন চায়।’ হাত বাড়াল কোবরাস। ‘রেডিও?’
ব্যাগ থেকে বের করে আসল মালিককে মোটাসোটা ট্রান্সমিটারটা ফিরিয়ে দিল জ্যাক। এটার মাধ্যমেই কোবরাসের দলকে সংকেত দিয়েছে। ‘আরও মানুষজনের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে। চাইনিজ কর্তৃপক্ষ, ইউএস অ্যাম্বাসি…’
‘গল্পটা পোক্তভাবে সাজাবে, তাহলেই চলবে। আমেরিকায় ফেরার সাথে সাথে পারিশ্রমিক পৌঁছে যাবে। ভবিষ্যতে কেউ ওয়াইল্ডদের পথে হাঁটতে চাইছে- টের পাওয়ামাত্র জানাবে আমাকে। ঠিক আছে?’
‘এজন্যই তো পয়সা পাচ্ছি,’ মিনমিন করে বলল বিশ্বাসঘাতক লোকটা।
শীতল হাসি দেখা গেল কোবরাসের মুখে। চলে এসেছে হেলিকপ্টার। কালো আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে নেভিগেশন লাইট।
পাঁচ মিনিট পর রওনা দিল যান্ত্রিক ফড়িং। পেছনে পড়ে রইল শুধু কয়েকটা লাশ।
-Andy McDermott
Translated by Adnan Ahmed Rizon
Published by Chirkut Prokashoni