Bird Box- Part 1

অধ্যায় এক

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে ম্যালরি, ভাবছে।

হাত ভেজা। কাঁপছে ও। চিন্তিত ভঙ্গীতে পায়ের আঙুল ঠুকছে ভাঙা টাইলসের মেঝেতে। ভোর হবে হবে ভাব। সূর্য মনে হয় সবেমাত্র উঁকি দিচ্ছে দিগন্তে। আবছা আলোর পরত লাগায় জানালার ভারী পর্দায় ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার ফিকে হয়েছে একটু। দেখতে দেখতে নতুন চিন্তা উদয় হলো ম্যালরির মনে।

কুয়াশা…

কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে হলের নিচে ঘুমায় বাচ্চারা। হয়তো একটু আগে উঠান থেকে আসা আওয়াজ শুনেছে। ম্যালরির সৃষ্টি করা শব্দ মাইক্রোফোন পেরিয়ে বিছানার পাশের অ্যামপ্লিফায়ার পর্যন্ত না আসার কোন কারণ নেই।

নিজের হাতের দিকে তাকাল ও। মোমের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, হাতগুলো ভেজা। সকালের শিশির এখনও লেগে আছে তালুতে।

মোমবাতি নেভানোর আগে বড় করে নিঃশ্বাস নিল ম্যালরি। তারপর চোখ বুলাল ছোট্ট ঘরের চারপাশে। জিনিপত্রে মরিচা ধরেছে। বাসনকোসনগুলো ভাঙা। কার্ডবোর্ডের বক্স ব্যবহৃত হয়েছে ময়লার ঝুড়ি হিসেবে। চেয়ারগুলোর কয়েকটা সুতো দিয়ে বাঁধা। নোংরা দেয়ালে বাচ্চাদের হাত-পায়ের ছাপ। কিছু পুরনো দাগও রয়েছে।

হলের দেয়ালের নিচের অংশে রঙ চটে গেছে। এককালের বেগুনি আজ পরিণত হয়েছে বাদামিতে। এগুলো রক্ত। লিভিং রুমের কার্পেটও বিবর্ণ। ম্যালরি প্রাণপণে ঘষেও দাগ তুলতে পারেনি। কাজে লাগানোর মতো কোন কেমিক্যাল নেই বাড়িতে। অনেক আগে বালতিতে করে কুয়া থেকে পানি এনেছিল ও, তারপর স্যুট কোট ভিজিয়ে ঘষে ঘষে চেষ্টা করেছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর।

নাছোড়বান্দা দাগগুলো হার মানেনি। এমনকি যা-ও কিছুটা গেছে, ছায়ার মতো নিজেদের ছাপ রেখে যেতে ভোলেনি। ফয়ারের একটা ফোকরে এক বক্স মোমবাতি রাখা ছিল। লিভিং রুমের কাউচ অদ্ভূতভাবে বাঁকানো। ল্যাপ্টানো দুটো দাগের উপর চাপা দেয়া, যা দেখে ম্যালরির নেকড়ের মাথা বলে মনে হয়।

দ্বিতীয় তলায় সিঁড়ির উপরে একগাদা ছাতাপড়া পুরনো কোট, বেগুনি দাগে ভর্তি, দেয়ালের ভেতর গেঁথে আছে যেন। তার দশ ফুট সামনে গোটা বাড়ির সবচেয়ে বিচ্ছিরি কালচে দাগটা। দ্বিতীয় তলার অপর প্রান্তে কী আছে, ম্যালরি জানে না। কারণ ওই দাগ অতিক্রম করার সাহস তার হয়নি।

একসময় ডেট্রয়েট শহরতলীর খুব সুন্দর একটা বাড়ি ছিল এটা। নিরাপদ, অভিজাত… একটা পরিবারের থাকার পক্ষে উপযুক্ত। মাত্র পাঁচ বছর আগে হয়তো কোন রিয়েল-এস্টেট এজেন্ট গর্বভরে এই বাড়ির গুণকীর্তন করত কাস্টোমারদের সামনে।

কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পুর্ণ আলাদা। জানালাগুলোতে কার্ডবোর্ড আর কাঠের আস্তর দেয়া। পানির লাইন অচল। কিচেন কাউন্টারের উপর বিশাল একটা কাঠের বালতি। স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। বাচ্চাদের খেলার মতো কোন খেলনা নেই, তাই একটা চেয়ারের ভাঙা টুকরো ওদের সম্বল। কাঠের টুকরোগুলোর উপর কাঁচা হাতে আঁকা ছোট ছোট মুখ। কাপবোর্ডগুলো খালি। দেয়ালে কোন ছবি আঁকা নেই এখানে।

পেছনের দরজার নিচ থেকে তার বেরিয়ে এসে ঢুকেছে একতলার বেডরুমে, যার সাথে যুক্ত অ্যামপ্লিফায়ারগুলো বাইরে থেকে কোন আওয়াজ এলে ম্যালরি আর বাচ্চাদের সতর্ক করে। এভাবেই কাটছে তিনজনের জীবন। অনেক দিন হয় কেউ বাইরে যায়নি। আগে যখন গিয়েছে, চোখে বাঁধা ছিল পট্টি।

বাড়ির বাইরের দুনিয়া কেমন হতে পারে, সেসম্পর্কে বাচ্চাদের কোন ধারনা নেই। এমনকি জানালা দিয়েও তাকানোর অনুমতি নেই ওদের। ম্যালরি নিজেও চার বছর ধরে চোখ রাখে না জানালার ফ্রেমের ওপাশে।

চারটা বছর…

আজ এই সিদ্ধান্তটা না নিলেও চলে। মিশিগানে এখন অক্টোবর মাস চলছে। বেশ ঠাণ্ডা। নদী ধরে বিশ মাইল পথ বাচ্চা দুটোর পক্ষে সহজ হবে না। খুব কম বয়স ওদের। যদি কেউ একজন পানিতে পড়ে যায়? চোখ বাঁধা অবস্থায় ম্যালরি কী করবে তখন?

একটা দুর্ঘটনা, ম্যালরি মনে মনে ভাবল। খুব বাজে ব্যাপার হবে। এতদিন ধরে এত এত কষ্ট, বেঁচে থাকার এত মরিয়া প্রচেষ্টার পর মরতে হবে একটা সাধারণ দুর্ঘটনায় পড়ে।

পর্দাগুলোর দিকে তাকাল ম্যালরি। কাঁদতে শুরু করল আবার। কারও উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে মন চাইছে। কারও কাছে মিনতি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু কথা শোনার মতো কেউ নেই। এসব ঠিক না, বলতে চাইল ও। নিষ্ঠুর পরিস্থিতি।

কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকাল ম্যালরি। কিচেনে ঢোকার মুখ, বাচ্চাদের বেডরুমে যাওয়ার হল। পাল্লাহীন দরজার ফ্রেমের ওপাশে নীরবে ঘুমাচ্ছে বাচ্চারা। কালো কাপড়ে মোড়া ছোট্ট শরীর দুটো, আলো ঢোকার সুযোগ নেই। নড়ছে না কেউ। বোঝা যাচ্ছে, জেগে ওঠেনি। তবু হয়তো শুনতে পাচ্ছে ওরা। এই একটা কাজই ভালো পারে বাচ্চা দুটো। জন্মের পর থেকে ম্যালরি ওদের শুধু কানের উপর ভরসা করতে শিখিয়েছে। তাই এখন মাঝে-মাঝে ওর মনে হয়, বাচ্চারা হয়তো ওর চিন্তার ফিসফিসানিও টের পায়।

সূর্য ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে ম্যালরি। আকাশে উজ্জ্বল আলো থাকবে তখন। নৌকায় আরও বেশি নজর দেয়া যাবে। বাচ্চাদের বলে দিতে হবে চারদিকে কান পেতে রাখার জন্য। মাত্র চার বছর বয়স ওদের, তবে শব্দ শোনার ক্ষেত্রে পটু হয়ে ওঠেছে দু’জনেই। চোখ বাঁধা অবস্থায় একা নৌকা চালানো পাগলের প্রলাপের মতো শোনায়। বাচ্চাদের সাহায্য চাই ম্যালরির। ওদের কানের উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সে পরামর্শ দেয়ার মতো যোগ্যতা বাচ্চাদের হয়েছে তো? বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি তো ওরা? চিরকালের জন্য?

কিচেনের একটা চেয়ারে বসে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল ম্যালরি। জুতা খোলা পায়ের আঙুল এখনও আনমনে মেঝেতে ঠুকছে। আস্তে আস্তে সেলারের সিঁড়ির দিকে তাকাল এরপর। ওখানে দাঁড়িয়ে একসময় টম নামে একজনের সাথে কথা বলেছে ও… ডন নামে আরেকজনের ব্যাপারে। তারপর চোখ ফেরাল সিংকের উপর। ওখানে একসময় কুয়া থেকে বালতি বালতি পানি তুলে আনত ডন। ভয়ে কাঁপত বাইরে থেকে ফেরার পর। সামনে ঝুঁকে ফয়ার দেখতে পেল ম্যালরি। শেরিল ওখানে দাঁড়িয়ে পাখিদের জন্য খাবার তৈরি করত। সামনের দরজার আগে হচ্ছে লিভিং রুম। এখন অন্ধকার আর নীরব হলেও জায়গাটা এককালে অনেকগুলো লোকে গিজগজ করত। মনে পড়লে ম্যালরি স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে।

মাত্র চারটা বছর, মনে মনে বলল ও। সাথে সাথে ইচ্ছা হলো সর্বশক্তিতে ঘুসি হাঁকায় দেয়ালে।

ম্যালরি জানে, এই চার বছর খুব সহজে আট বছরে রূপ নিতে পারে। তারপর বারো। ততদিনে বড় হয়ে যাবে বাচ্চারা। তবু আকাশ দেখা জুটবে না কারও ভাগ্যে। কখনও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবে না ওরা। এভাবে মনে মনে এই অতিরিক্ত বারোটা বছর বেঁচে থাকার মানে কী? চোখে বাঁধা পট্টির আড়াল এভাবে বাঁচাকে কি আদৌ জীবনে বলা যায়?

ঢোক গিলল ম্যালরি। ভাবছে সম্ভাবনাটার কথা। সে কি পারবে বড় হওয়া অব্দি এভাবে ওদের দেখভাল চালিয়ে যেতে?

কতদিন ধরে চলবে এসব? আগামী দশ বছর? যতদিন না বাচ্চারা বড় হয়ে মায়ের দেখভালের দায়িত্ব নেয়? এমন করে লাভটাই বা কী?

তুমি খুব খারাপ মা, নিজেই নিজেকে বলল তারপর।

আকাশের বিশালতা বোঝে না বাচ্চারা। খোলা মাঠে দৌড়াতে পারে না। রাস্তাঘাট, অলিগলি, পাশের বাড়ির প্রতিবেশী সম্পর্কে কোন ধারনা ওদের নেই। জানে না রাতের আকাশে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা দেখার আনন্দ কেমন হতে পারে।

এমন এক জীবন সে ওদের উপহার দিচ্ছ, যেটাকে আসলে জীবন বলা চলে না।

পানিতে ঝাপসা হয়ে থাকা দৃষ্টিতে দেখল ম্যালরি, পর্দার ওপাশে অন্ধকার আরেক পোঁচ সাদা হয়েছে। বাইরের কুয়াশা বেশিক্ষণ থাকবে না। হয়তো এই ঘোলাটে পরিবেশই গা বাঁচিয়ে নদী পর্যন্ত যেতে সবাইকে সাহায্য করবে। এখনই জাগিয়ে দিতে হবে বাচ্চাদের।

কিচেনের টেবিলে দুম করে থাবা বসাল ম্যালরি। মুছল দুই চোখ। তারপর উঠে হল ধরে গিয়ে ঢুকল বাচ্চাদের বেডরুমে।

‘ছেলে!’ চেঁচিয়ে ডাকল ও। ‘মেয়ে! উঠে পড়ো সবাই!’

ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। একটামাত্র জানালা, তাও মোটা কম্বল দিয়ে ঢাকা। সূর্যের আলোর এখানে আসার অধিকার নেই। ঘরের দুই পাশে দুটো ম্যাট্রেস। উপরে কালো ডোম। আকৃতিগুলোকে খাড়া করে রাখা তারগুলো একসময় বাড়ির পেছনে ছিল, কুয়ার পাশে ছোট বাগানে বেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বিগত চার বছর ধরে কাজে লাগছে ছাউনি হিসেবে। ভেতরে ঘুমানো বাচ্চাদের দৃষ্টি সামলে রাখে।

ডোমগুলোর ভেতর নড়াচড়া টের পেল ম্যালরি। তারপর উবু হয়ে বসে মেঝেতে পোঁতা পেরেক থেকে খুলে দিল তারের প্রান্ত। অন্য হাতে পকেট থেকে বের করে আনছে পট্টি। বাচ্চা দুটোর ঘুম ঘূম চোখে পরিয়ে দেবে।

‘মা?’

‘উঠে পড়ো জলদি। মা চায় তোমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হও।’

সাথে সাথে সাড়া দিল দু’জন। কোন মোচড়ামুচড়ি নেই, অভিযোগ নেই।

‘কোথায় যাব আমরা?’ মেয়েটা জানতে চাইল।

ওর হাতে একটা পট্টি ধরিয়ে দিল ম্যালরি। ‘এটা পরে নাও। আমরা নদীর দিকে যাব।’

চটপট কালো কাপড় দুটো চোখে দিল বাচ্চারা। অভ্যস্ত হাতে মাথার পেছনে বেঁধে ফেলল দুই প্রান্ত। এই কাজটা ওদের খুব পরিচিত। সব স্বাভাবিক থাকলে হয়তো চার বছর বয়সে কোন খেলাধুলার সাথে এভাবে পরিচিত হতো দু’জন, ভাবতে ম্যালরির বুক ফাঁকা হয়ে গেল। সাধারণত এই বয়সে বাচ্চাদের মনে প্রচণ্ড কৌতূহল কাজ করে। ওদের জিজ্ঞেস করা উচিত- কেন নদীর দিকে যেতে হবে? কিংবা আজকেই কেন? কিন্তু এসব না করে ওরা স্রেফ মায়ের আদেশ পালন করছে।

ম্যালরি এখনও নিজের পট্টি চোখে বাঁধেনি। আগে বাচ্চাদের তৈরি করতে হবে।

‘তোমার পাযল সাথে নাও,’ মেয়েকে বলল ও। ‘আর হ্যাঁ, দু’জনেই নিজ নিজ কম্বল নেবে।’

মনে মনে খুব উত্তেজনা বোধ করছে ম্যালরি। ব্যাপারটা হিস্টিরিয়ার চেয়ে খারাপ। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল ও। দরকারি জিনিস খুঁজছে, যা হয়তো পথে কাজে লাগতে পারে।

হঠাৎ নিজেকে খুব অপ্রস্তুত মনে হলো ম্যালরির। নিরাপত্তার খুব অভাব বোধ হচ্ছে। পায়ের নিচের মেঝে যেন মিলিয়ে গেছে বাতাসে, বাড়িটাও তাই। অনিশ্চিত পৃথিবীতে ও এখন একা। নিজের অজান্তেই পট্টিটা মুঠো করে ধরল ম্যালরি। জানে যত জিনিসপত্র সাথে নিক না কেন, অস্ত্র হিসেবে যা-ই ব্যবহার করুক, এই পট্টির চেয়ে বড় নিরাপত্তা অন্য কিছু দিতে পারবে না।

‘কম্বল নিয়ে এসো!’ বাচ্চাদের মনে করিয়ে দিল ম্যালরি। শুনতে পাচ্ছে দুটো ছোট্ট শরীরের হুটোপুটির আওয়াজ। অপেক্ষা না করে তারপর নিজেই এগোল ওদের সাহায্য করার জন্য।

ছেলেটার শারীরিক গঠন বয়সের তুলনায় একটু কম; তবে শক্তপোক্ত গড়ন, এজন্য ম্যালরি বেশ গর্ব অনুভব করে। দুটো শার্টের দিকে দ্বিধান্বিত চোখে তাকাচ্ছে এখন। ভাবছে কোনটা পরবে। তবে দুটো কাপড়ই ওর তুলনায় বড়। এগুলোর আসল মালিক ছিল…

থাক সে কথা।

ছেলের জন্য একটা কাপড় পছন্দ করে দিল ম্যালরি। সাথে সাথে ছেলেটার কালো চুল হারিয়ে গেল শার্টের নিচে, বের হলো মাথার ফুটো দিয়ে। মাপ দেখে ম্যালরি বুঝতে পারল, ও সম্প্রতি গায়েগতরে একটু বেড়েছে।

মেয়েটার শারীরিক গড়ন অবশ্য বয়সের তুলনায় ঠিকঠাক। মাথা আগে দিয়ে একটা জামার ভেতর ঢুকতে চাইছে ও। পুরনো বিছানার চাদর দিয়ে বানানো কাপড়টা ম্যালরির সেলাই করা, বাচ্চাটা নিজেও সাহায্য করেছিল।

‘বাইরে খুব ঠাণ্ডা, মেয়ে। এক জামায় কাজ হবে না।’

বাচ্চাটা ভ্রুকুটি করল। সদ্য ঘুম ভাঙায় এলোমেলো হয়ে আছে সোনালি চুল।

‘আমি প্যান্টও পরব, আম্মু। আর কম্বল তো সাথে নেবই।’

ম্যালরির রাগ হলো। নিজের কথায় কোন প্রতিবাদ শুনতে চায় না ও। অন্তত আজকের দিনে নয়। এমনকি বাচ্চাদের কথায় যুক্তি থাকা সত্ত্বেও না।

বাইরের দুনিয়ার পরিত্যক্ত মল-রেস্টুরেন্ট, হাজার হাজার নষ্ট গাড়ি, দোকানের তাকে পচে যাওয়া জিনিসপত্র ইত্যাদি সব যেন তাকিয়ে আছে এই বাড়ির দিকে। ফিসফিস করে সতর্ক করছে অনাগত বিপদের ব্যাপারে।

বেডরুমের ক্লযেট থেকে একটা কোট তুলে নিল ম্যালরি। তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এই শেষ। আর কখনও ফিরবে না এখানে।

‘আম্মু,’ হল থেকে মেয়েটা ডাকল। ‘আমাদের বাইসাইকেল হর্নগুলো দরকার হবে নাকি?’

ম্যালরি নাক দিয়ে বড় করে বাতাস টানল।

‘না,’ জবাব দিল তারপর। ‘আমরা সবাই একসাথে থাকব। সবসময়।’

মেয়েটা বেডরুমে ফিরে যেতে আবার চিন্তায় আচ্ছন্ন হলো ম্যালরির মন। কী হতাশাজনক ব্যাপার! বাইসাইকেল থেকে খুলে আনা এই হর্নগুলো বাচ্চাদের দেখা সবচেয়ে মজার জিনিস। বছরের পর বছর ধরে এগুলো দিয়ে খেলে আসছে ওরা। মাঝে-মাঝে  লিভিংরুম থেকে ভেসে আসা টুংটাং আওয়াজে ম্যালরির মনে ভয় ধরে যেত। তবু বাধা দেয়নি ওদের খেলায়। কখনও লুকিয়েও রাখেনি জিনিসগুলো। নতুন মাতৃত্বের উদ্বিগ্ন মনেও ম্যালরি বুঝতে, বাচ্চাদের হাসির খোরাক হওয়া হর্নগুলো ওদের জন্য কতটা দরকারি।

মাঝে-মাঝে তো বেল বাজিয়ে ভিক্টরকে ভয় দেখাত ওরা।

আহ, ভিক্টর! কুকুরটাকে খুব ভালোবাসতো ম্যালরি। বাচ্চাদের বড় করে তোলার প্রথমদিকে যখন নদী ধরে পালানোর কথা ভাবত ও, সেই পরিকল্পনায় ভিক্টরকেও শামিল করে নিত। পাশে বসে হয়তো তাকে সতর্ক করতে পারতো কুকুরটা, কিংবা নিজেও মোকাবেলা করতে পারতো বাইরের কোন জীবজন্তু বা মানুষ হামলা চালালে।

‘ঠিক আছে।’ বাচ্চাদের বেডরুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল ম্যালরি। ‘হয়েছে। এবার চলো।’

আগে মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের বলেছে ও, একদিন হয়তো এমন দিন আসবে। তবে নদী ধরে এগোনোর ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছে নিছক একটা ভ্রমণ হিসেবে। ঘূণাক্ষরেও পালানোর নাম নেয়নি। এতে বাচ্চারা বুঝে ফেলত এতদিন ওরা যেভাবে বাঁচছে, তা থেকে একদিন পালিয়ে যেতে হবে।

এসবের বদলে ম্যালরি ওদের লোভ দেখিয়েছে ভবিষ্যতের… যেদিন তড়িঘড়ি করে জাগিয়ে দেবে ঘুম থেকে, চিরতরে চলে যেতে হবে এই বাড়ি ছেড়ে। চারটা বছর ধরে এই দিনের অপেক্ষায় ছিল ওরা। কাপবোর্ডে সবসময় ছোট্ট পাউচে খাবার মজুদ থাকত। পচে গেলে পাল্টে দেয়া হতো প্যাকেট। ম্যালরির বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ ছিল ওগুলো। দেখলে তো, কাপবোর্ডের এই খাবারগুলো আমাদের ওই পরিকল্পনার অংশ।

আজই সেই দিন। আজকের এই সকাল, এই মুহূর্ত, এই কুয়াশার চাদর।

বাচ্চা দুটো এগিয়ে এলে ম্যালরি ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। পরীক্ষা করে দেখল প্রত্যেকের চোখের পট্টি। সব ঠিকঠাক আছে। ছোট্ট মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ম্যালরি বুঝল, অবশেষে বাড়ি যাওয়ার জন্য ওরা তৈরি।

‘আমার কথা শোনো,’ কড়া গলায় বলল তারপর। ‘আজ একটা নৌকা নিয়ে নদী ধরে রওনা দেব আমরা। লম্বা রাস্তা হতে পারে। আমি যা বলব অক্ষরে অক্ষরে মানবে তোমরা, বুঝেছ?’

কচি গলায় আলাদা আলাদা জবাব এল।

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

‘বাইরে অনেক ঠাণ্ডা। প্রত্যেকের সাথে কম্বল আছে। চোখে বাঁধা থাকবে পট্টি। এর বেশি কিছু লাগবে না। বুঝতে পারছো আমার কথা?’

জবাব এল সাথে সাথে।

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

‘যা-ই হোক না কেন, কেউ চোখের বাঁধন খুলবে না। খুললে মার খাবে আমার হাতে। বুঝতে পেরেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমাদের সাহায্য লাগবে আমার। সতর্কভাবে কান পেতে রাখবে চারদিকে। নদীতে থাকার সময় পানির পাশাপাশি জঙ্গলের আওয়াজও শুনতে হবে। জীবজন্তুর শব্দ পেলে আমাকে জানাবে। পানিতে কিছু শুনলেও ডাকবে আমাকে। বুঝলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

‘অহেতুক কোন প্রশ্ন করবে না। ছেলে, তুমি বসবে নৌকার সামনের অংশে। মেয়ে, তুমি পেছনে। নৌকায় উঠে আমি যার যার জায়গায় বসিয়ে দেব তোমাদের। আর আমি থাকব মাঝে, দাঁড় বাওয়ার জন্য। বাড়তি কোন কথা বলা যাবে না। ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

‘গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে কোন কিছুর জন্য থামব না আমরা। পৌঁছে গেলে আমি বলব তোমাদের। তার আগে কোন ঝামেলা চাই না। খিদে পেলে এই পাউচ থেকে খাবে চুপচাপ।’

ছোট্ট হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল ম্যালরি।

‘ঘুমানো চলবে না। আবারও বলছি, ঘুমানো নিষেধ। তোমাদের কানের সাহায্য চাই আজ আমার। এজন্যই এভাবে তৈরি করেছি এতদিন।’

‘মাইক্রোফোন সাথে নেব আমরা?’ মেয়েটা জানতে চাইল।

‘না।’

বাচ্চাদের মুখের দিকে পালাক্রমে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল ম্যালরি।

‘বাড়ি থেকে বের হয়ে হাতে হাত ধরে আমরা কুয়ার পাশের পথ ধরে এগোব। নদীর দিকে যে রাস্তাটা গেছে, ওখানে ঝোপঝাড় জন্মেছে। পরিষ্কার করার জন্য মাঝে-মাঝে হাত ছাড়া লাগতে পারে। তখন নিজেরা হাত ধরাধরি করে থাকবে তোমরা, একজন আঁকড়ে ধরে রাখবে আমার কোট। ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

বাচ্চাগুলোর গলায় ভয় খেলা করছে নাকি?

‘আমার কথা শোনো। আমরা এমন এক জায়গায় যাব যেখানে তোমরা আগে কখনও যাওনি। এই বাড়ি ছেড়েই কোনদিন বের হওনি তোমরা। বাইরে এমন কিছু থাকতে পারে যা তোমাদের ব্যথা দেবে, কষ্ট দেবে আমাকেও। তাই আমার কথা না শুনলে বিপদে পড়তে হবে।’

চুপ করে থাকল দু’জন।

‘বুঝতে পেরেছ আমার কথা?’

‘হ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ।’

যাক, প্রশিক্ষণ শেষ। এবার কাজে নামার পালা।

‘ঠিক আছে,’ ম্যালরির কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘আমরা এখন রওনা দেব। এখনই। চলে যাচ্ছি আমরা।’

বাচ্চাদের মাথা নিজে কপালে আঁকড়ে ধরল ও। তারপর হাত ধরে রওনা দিল বাইরে।

কিচেন পর্যন্ত এসে গাল থেকে পানির শেষ ফোঁটাগুলো মুছল ম্যালরি। কাঁপতে কাঁপতে পট্টি বাঁধল নিজের চোখে। সব শেষে হাত রাখল ডোরনবে। গত কয়েক বছরে এই দরজা পেরিয়ে কুয়া থেকে হাজার হাজার বালতি পানি টেনে এনেছে বাড়ির ভেতর।

আজ সব ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রূঢ় বাস্তবতা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে হৃদয়কে।

দরজা খোলার সাথে সাথে ঠাণ্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে দিল। বাইরে পা রাখল ম্যালরি। ভয় ভয় লাগছে বুকের ভেতর। তবে বাচ্চাদের সামনে এই অনুভূতি প্রকাশ করা যাবে না। এই প্রভাব পড়ল মুখ দিয়ে বের হওয়া কথায়। প্রায় চিৎকারের শামিল।

‘আমার হাত ধরে রাখো। দু’জনেই।’

ছেলেটা ম্যালরির বাম হাত ধরল। মেয়েটার ছোট ছোট আঙুল আঁকড়ে ধরল ডান হাত।

চোখ বাঁধা অবস্থায় যাত্রা শুরু করল তিনজন।

কুয়াটা বিশ কদম সামনে। ছবির ফ্রেম ভেঙে বের করা ছোট ছোট কাঠের টুকরো পথনির্দেশ করছে। এগুলো অনুভব করে করে দিকনির্ণয় করতে হবে। পথের দু’পাশে পুঁতে রাখা কাঠগুলো আগেও অনেকবার জুতো দিয়ে অনুভব করেছে বাচ্চারা। ম্যালরি একবার ওদের বলেছিল, কুয়ার পানি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ। এতে করে জায়গাটার প্রতি অন্যরকম একটা ভক্তি আসে ওদের। তাই পানি নিতে মা-কে সাহায্য করায় কখনও ক্লান্ত হয়নি কেউ।

কুয়ার পর থেকে পায়ের নিচে এবড়োখেবড়ো মাটি ঠেকল। কেমন যেন অপ্রাকৃত সব, অতিরিক্ত নরম।

‘এই যে এদিকে,’ ম্যালরি বলল।

সাবধানে বাচ্চাদের নিয়ে আগে বাড়ল তারপর। কুয়া থেকে দশ গজ সামনে আরেকটা পথের শুরু। দুই পাশে গাছের সারি। এখান থেকে নদী একশো কদমও হবে না। বাচ্চাদের হাত ছেড়ে পথের নাগাল পাওয়ার জন্য হাতড়াল ম্যালরি।

‘আমার কোট ধরে রাখো!’

ডালপালা হাতড়ে একটা ট্যাংক টপ খুঁজে পেল ও। গাছের সাথে বেঁধে রাখা। রাস্তা বদলানোর চিহ্ন। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এখানে ঝুলছে কাপড়টা।

ছেলেটা ম্যালরির পকেটের ঝুল আঁকড়ে ধরে রেখেছে, মেয়েটা ধরেছে ওর হাত। হাঁটতে শুরু করল সবাই। একটু পরপর ম্যালরি প্রশ্ন করছে, ওরা ঠিকমতো পরস্পরকে ধরে রেখেছে কি না। হঠাৎ মুখে গাছের ডালের খোঁচা লাগল। চিৎকার আটকাতে বেগ পেতে হলো ওকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে পরের চিহ্নের কাছে পৌঁছে গেল ছোট দলটা। কিচেন চেয়ারের একটা ভাঙা পা, দাঁড়িয়ে আছে একদম পথের মাখখানে। ম্যালরির লাথি লেগে উল্টে পড়ল জিনিসটা।

চার বছর আগে নৌকাটা আবিষ্কার করে ম্যালরি। নিজেদের বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ বাড়ি পরে নোঙর করা অবস্থায়। এক মাসের বেশি হয় এখানে পরীক্ষা করতে আসা হয়নি। তবে ও আশা করছে জিনিসটা জায়গামতোই আছে।

কিন্তু যদি না থাকে? যদি অন্য কেউ নিয়ে যায়? তাহলে কী হবে?

ঘাটে যাওয়ার আগেই আরাধ্য আওয়াজটা ম্যালরির কানে এল। পানিতে দুলছে নৌকাটা। থেমে বাচ্চাদের চোখের পট্টিতে হাত বুলাল ও। শক্ত করে দিল গিঁট। তারপর এগোল কাঠের জেটির দিকে।

হ্যাঁ, আছে ওটা। বাড়ির বাইরে অকেজো গাড়িগুলো যেমন বছরের পর বছর ধরে পড়া, তেমনিভাবে নিজের অবস্থানে টিকে আছে এই বাহনটাও।

বারি থেকে এত দূরে ঠাণ্ডার প্রকোপ বেশি। পানির ছল-ছলাৎ আওয়াজ মনে ভয় সঞ্চার করছে। উবু হয়ে নৌকার স্টিলের আগার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল ম্যালরি। বাচ্চাদের হাত ছেড়ে দিয়েছে আগেই। সবার আগে দড়ির নাগাল পাওয়া গেল।

‘ছেলে,’ নৌকার বরফ শীতল ধাতব মাথা ধরে ঘাটের দিকে টানল ম্যালরি। ‘সামনে, সামনে উঠে পড়ো।’ বলে নিজেও সাহায্য করল উঠতে। স্থির হয়ে বসানোর পর বাচ্চাটার মুখ স্পর্শ করল দুই হাতে। ‘শুনতে থাকো। পানির দিকে কান রাখবে। ভুল যেন না হয়।’

মেয়েটাকে ঘাটে থাকতে বলে হাতড়ে হাতড়ে দড়ির বাঁধন খুলল ম্যালরি। তারপর সাবধানে উঠল মাঝের বেঞ্চে। সব শেষে বাচ্চাটাকেও উঠতে সাহায্য করল। পাগলের মতো দুলছে ওদের বাহন। অস্ফূট কণ্ঠে আঁতকে উঠল মেয়েটা। আঁকড়ে ধরেছে মায়ের হাত।

নৌকার নিচে পাতা, কাঠি ইত্যাদি হরেক রকম আবর্জনা জমেছে। কিছুটা পানিও আছে। সবকিছুর মাঝে হাত চালিয়ে ম্যালরি বৈঠাগুলো খুঁজে নিল। ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে কাঠের হাতল। ছত্রাকের গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাত্তা না দিয়ে ওগুলো তুলে নিল ম্যালরি, বসাল স্টিলের খাঁজে। এখনও যথেষ্ট মজবুত। একটা দিয়ে ঘাটে ধাক্কা দিল ও…

নেমে এল নদীতে।

পানি মোটামুটি শান্ত। জঙ্গলের দিক থেকে অস্ফূট আওয়াজ হঠাৎ ওদের পিলে চমকে দিল। কী যেন নড়ে উঠেছে ওদিকে।

কুয়াশার কথা ভাবল ম্যালরি। আশা করছে, কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পালাতে পারবে।

কিন্তু ক্রমশ সরে যাবে কুয়াশা।

‘বাচ্চারা,’ বড় করে দম নিল ম্যালরি। ‘শুনতে থাকো।’

অবশেষে চার বছরের অপেক্ষা, প্রশিক্ষণ, আর জমা করা সাহসের উপর ভর করে বৈঠায় জোর খাটাল ও। পানি কেটে নৌকা এগোতে শুরু করেছে। দূরে সরে যাচ্ছে নদীর তীর, পেছনে পড়ছে বাড়ি। খুব বেশিদিন এই বাড়িতে থাকেনি ওরা, মাত্র চার বছর… কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে ছিল এখানেই।

 

-Josh Malerman

Translated by Adnan Ahmed Rizon

Published by Adee Prokashon

The Hunt For Atlantis- Part 1

প্রারম্ভ

তিব্বত

হিমালয়ের চূড়া পেরিয়ে সূয্যিমামা এখনও দেখা দেননি, তবে জেগে উঠেছে হেনরি ওয়াইল্ড। আসলে দুই ঘন্টার বেশি সময় ধরে জেগেই আছে, অপেক্ষা করছে কখন ভোরের সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হবে পাহাড়গুলো।

দুই ঘন্টা জেগে থাকলেও তার এই অপেক্ষা আরও আদিম, মনে মনে ভাবল সে। বছরের পর বছর, জীবনের বেশিরভাগ সময়। ছেলেবেলার কৌতুহল পরিণত হয়েছে নেশায়।

‘নেশা’ শব্দটা ব্যবহার করতে একটু ইতস্তত করল সে। তবে এটাই সত্যি। এই নেশার কারণে অ্যাকাডেমিক জীবনে সইতে হয়েছে অসহ্য বিদ্রুপ আর উপহাস। জীবনভর উপার্জনের অধিকাংশ খরচও হয়েছে এর পেছনে।

তবে নিজেকে মনে করিয়ে দিল হেনরি- এই নেশাই তাকে মিলিত করেছে জীবনের দুই স্মরণীয় নারীর প্রথম জনের সাথে।

‘সূর্যোদয়ের আর কতক্ষণ বাকি?’ লরা ওয়াইল্ড জানতে চাইল। বিশ বছরের বেশি সময় ধরে সংসার করছে হেনরির সাথে, পারকা গায়ে গুটিসুটি মেরে পাশে শোয়া এখন। নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েশনে দু’জনের প্রথম দেখা হয়। ছয় ফুটি হেনরির মাথায় তুষারের মতো সাদা চুল, ওদিকে লরার গাঢ় লালরঙা কেশরাশি দেখলে মনে হত যেন প্রাকৃতিক কিছু না। নিজের নেশার ব্যাপারে একটা রচনা লিখে প্রফেসরের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার পর হেনরি যখন লরার মুখে শুনল- ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি,’ লালচুলো মেয়েটার প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি এক মুহূর্ত।

‘যে কোন সময়,’ হেনরি ঘড়ি দেখে জবাব দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরল স্ত্রী-কে। ‘নিনা আমাদের সাথে থাকলে কত ভালো হত।’ নিনা হচ্ছে ওদের মেয়ে, হেনরির জীবনের দ্বিতীয় স্মরণীয় নারী।

‘ওর পরীক্ষার সময় এক্সপেডিশনে এলে তো এমনই হবে,’ লরা ভর্ৎসনা করল।

‘আমাকে দোষ দেয়ার বদলে চাইনিজ সরকারকে দাও। আমি তো পরের মাসেই আসতে চাইছিলাম, কিন্তু ওরা কোন কথা শুনতে নারাজ। হয় এখন নয়তো…’

‘হানি?’

‘কি?’

‘মজা করছিলাম। আমিও সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। তবে হ্যাঁ, নিনা থাকলে আসলেই ভালো হত।’

‘শুলাওডাং থেকে পোস্টকার্ড পাঠালে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ হবে না মনে হয়, তাই না?’ হেনরি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ‘গোটা পৃথিবীতে একের পর এক গন্তব্যে ওকে নিয়ে ছুটে বেরিয়েছি আমরা, সব ছিল কানাগলি। এখন অবশেষে সত্যিকার একটা সূত্র পেলাম, আর বেচারি আসতেই পারল না!’

‘আমরা ভাবছি যে সূত্রটা সত্যিকারের,’ লরা শুধরে দিল।

‘এক মিনিটের মধ্যেই জানা যাবে সত্যি না মিথ্যা, তাই না?’ সামনের দৃশ্যের দিকে ইঙ্গিত করল হেনরি। আকারে প্রায় সমান, বরফে ঢাকা তিনটা পাহাড়চূড়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওদের ক্যাম্প করা মালভূমির পরে। এখন পাহাড়ের ছায়ার মধ্যে আছে, কিন্তু সূর্য আরেকটু উপরে উঠলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। যেসব গালগল্প একত্রিত করে এখানে আসা, তা যদি সত্যি হয় তাহলে…

উঠে দাঁড়াল হেনরি। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিল তারপর। মহিলা নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল। প্রবল ঠাণ্ডায় উষ্ণ বাতাস বাইরে বের হয়েই যেন জমে যাবার যোগাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জায়গাটা দশ হাজার ফুটের বেশ উঁচু। বাতাস যেমন পাতলা, তেমনই শীতল। আগে কখনও এমন অভিজ্ঞতা পায়নি ওরা। তবে শাপে বর হিসেবে এখানকার হাওয়া যে কোন ধরণের দূষণ থেকে মুক্ত। চারদিকে শুদ্ধতার ছাপ।

মনের গভীরে হেনরি বুঝতে পারছে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখানে পূরণ হবে।

ভোরের প্রথম সূর্যালোক পৌঁছে গেছে তিন পাহাড়চূড়ায়।

সবচেয়ে মাঝের পর্বতশৃঙ্গ বাকি দুটোর তুলনায় একটু উঁচু। তাই উজ্জ্বল রোদ সবার আগে ওটার গায়েই হামলা চালিয়েছে। চূড়া পেরিয়ে নামতে থাকল তরল পদার্থের মতো নরম আলো। বাকি দুই পর্বতশৃঙ্গ এখনও ছায়াতে।

‘এ তো সত্যি…’ হেনরি শান্ত গলায় বললেও তাতে মিশে আছে চাপা উত্তেজনা।

লরার কণ্ঠে বিস্ময়ের মাত্রা একটু কম। ‘সোনার পাহাড় বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।’

স্ত্রীর দিকে ফিরে হাসল হেনরি। তারপর আবার তাকাল সামনে। ‘ওরা ঠিকই বলেছে। হে ঈশ্বর, ঠিক বলেছে ওরা!’

‘একদিক থেকে ব্যাপারটা হতাশাজনক,’ লরা বলল। ‘পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় আগে একদল নাৎসি সর্বপ্রথম এটার কথা জানতে পারে। খুব কাছাকাছি চলেও এসেছিল ওরা।’

‘কিন্তু খুঁজে তো আর পায়নি,’ হেনরি চোয়াল শক্ত করল। ‘আমরা পাব।’

এই সেই সোনার পাহাড়-আজকের আগপর্যন্ত যার অস্তিত্ব ছিল শুধু লোকগাথায়-হেনরির সারা জীবন ধরে একত্রিত করা ধাঁধার সর্বশেষ টুকরো। ওখানে ঠিক কি পাওয়া যাবে, জানা নেই কারও। তবে এটা নিশ্চিত, তা হেনরির লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক রহস্য…

আটলান্টিস।

*

সোনার পাহাড়ে রোদের খেলা মনে হয় এক মিনিটও টিকল না। তারপর সূর্য উঠে গেল আরও উঁচুতে, পাশের দুই চূড়া উদ্ভাসিত করতে। ততক্ষণে মাঝের পর্বতশৃঙ্গের পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছে অভিযাত্রী দলটা।

সাতজন মানুষ আছে দলে। তিন আমেরিকান ও চার তিব্বতি। পরের গ্রুপটাকে ভাড়া করা হয়েছে কুলি আর গাইড হিসেবে। এদিকটা মোটামুটি চেনা থাকলেও, লোকগাথা সত্যি হতে দেখে অতিথিদের মতো আশ্চর্য হয়েছে ওরা। সাধারণত এদিকে তেমন কেউ আসে না। হেনরি বুঝতে পারল একটু আগে যা দেখেছে, সম্ভবত আগে কোন পশ্চিমার চোখে পড়েনি এই দৃশ্য।

শুধুমাত্র যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এসেছে, তাদেরকে ছাড়া।

দলটাকে ডেকে দাঁড় করাল হেনরি। বাকিরা পাথর থেকে তুষার ঝেড়ে বসতে বসতে ও ব্যাকপ্যাক থেকে বের করল চিকন একটা খাতা। প্লাস্টিকের আবরণ দেয়া আছে কাগজগুলোতে।

লরা যোগ দিল স্বামীর সাথে। ‘আবার চেক করছ?’ গলায় কৌতুকের রেশ। ‘ভেবেছি এতদিনে হয়তো মুখস্ত করে ফেলেছ সব।’

‘জার্মান ভাষায় আমি অতটা পোক্ত নই।’ বিশেষ একটা পাতা খুলল হেনরি। সময় আর আবহাওয়ার আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় দাগ পড়েছে ওতে।

হেইনরিখ হিমলারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা জার্মান অ্যান্সেসট্রাল হেরিটেজ সোসাইটি, তথা আহনেনেরবে-র এই গোপন দস্তাবেজ উত্তর জার্মানির উইওয়েলসবার্গ ক্যাসলের এক সেলারের নিচে লুকিয়ে রাখা ছিল। এসএস-এর হেডকোয়ার্টার ছিল উইওয়েলসবার্গ, মিথলজি আর অতিপ্রাকৃতের ব্যাপারে নাৎসি আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যুদ্ধের শেষে এই দুর্গ আর তার মধ্যে সংরক্ষিত সকল জ্ঞান ধ্বংস করে ফেলার আদেশ দেয়া হয়। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ একজন নির্দেশ অমান্য করে সরিয়ে ফেলেছিল কিছু জিনিস।

তারই একটা চলে এসেছে ওয়াইল্ড দম্পতির হাতে।

বার্ন্ড রাস্ট, হেনরির এক পুরনো সহকর্মী এই আবিষ্কারের ব্যাপারে তাকে জানায়। বেশিরভাগ এসএস ডকুমেন্ট চলে গিয়েছিল জার্মান সরকারের হাতে। তবে ওয়াইল্ডদের আগ্রহের ব্যাপারে জানা থাকায় রাস্ট ক্যারিয়ার নষ্টের ঝুঁকি নিয়ে গোপনে উদ্ধার করে কয়েকটা পৃষ্ঠা- যাতে আটলান্টিসের ব্যাপারে উল্লেখ ছিল। বিক্রেতা পুরনো বন্ধু হলেও যথেষ্ট দাম দিতে হয়েছে জিনিসগুলোর জন্য। তবে হেনরি জানত, পয়সা উসুল হবে।

পাপী নাৎসিদের আবিষ্কারের বদৌলতে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে ভাবলে অস্বস্তি ভর করে হেনরির মনে। এজন্য মেয়েকেও জানায়নি কাগজপত্রগুলোর আসল ঠিকানা। জানে এসব ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব না। অর্ধশতাব্দী আগে এগুলোর মাধ্যমেই নাৎসিরা এই ট্রেইলের শেষ মাথায় পৌঁছে গিয়েছিল।

১৯৩০ সালে আহনেনেরবে তিব্বতে অভিযান শুরু করে। এক দশক পর যখন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ, তখনও থেমে থাকেনি জার্মানদের উঁচু সমাজের এই আগ্রাসন। থুলে সোসাইটির অংশ ছিল ওরা। হিমলার নিজেও তিনবার এশিয়া ঘুরে গেছে। থুলে সোসাইটি বিশ্বাস করত, হিমালয়ের নিচে আটলান্টিয়ানদের বানানো গোপন শহর আছে। জার্মানদের মতো আর্য জাতির মানুষ ছিল ওরা। তবে নিজেদের ওই অভিযান থেকে অভিযাত্রীরা তিব্বতের অনেক ইতিহাস উদ্ধার করতে পারলেও, আটলান্টিয়ানদের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। সবাই জার্মানিতে ফিরেছে খালি হাতে।

কিন্তু এখন হেনরির হাতে থাকা ডকুমেন্টে পাওয়া গেছে চার নম্বর অভিযানের অস্তিত্ব। ব্যাপারটা এমনকি হিটলারের কাছেও গোপন করা হয়েছিল।

অনুসারীদের মতো ফিউরার মিথলজিতে খুব একটা বিশ্বাস করত না। যুদ্ধ বাঁধার পর সে ঠিক করে- অর্ধেক পৃথিবীতে কিংবদন্তীর খোঁজে অভিযাত্রী পাঠিয়ে পয়সা খরচ করবে না, বরং তা ঢালবে নাৎসি ওয়ার মেশিনের পেছনে।

কিন্তু হিমলার ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আহনেনেরবে-র আবিস্কার ততদিনে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে- কিংবদন্তী চলে এসেছে প্রায় হাতের মুঠোয়।

একই ঘটনা ঘটেছে হেনরি আর লরার বেলাতেও, তবে আধা শতাব্দী পর। ডজন ডজন, ক্ষেত্রভেদে শত শত ঐতিহাসিক সূত্র অনুসরণ করে পাওয়া তথ্য একজোট করার পর অবশেষে মিলতে শুরু করে জিগস পাজলের টুকরো। মরক্কোর উপকূলে নিনাকে নিয়ে দশ বছর আগে এক অভিযানে গিয়েছিল ওয়াইল্ড দম্পতি। আফ্রিকান বালুর নিচে পাওয়া যায় প্রাচীন বসতি। তবে দেখা যায় কেউ আগেই হামলা চালিয়েছে ওখানে। দুয়েকটা জিনিস ছাড়া পুরো সাইট লুটেপুটে সাফ।

এখন হেনরি জানে কাজটা কাদের ছিল।

নাৎসিরাও একজোট করতে পেরেছিল পাজলের টুকরো। তারপর অভিযান চালায় মরক্কোতে। আহনেনেরবে-র কিছু দস্তাবেজে আবছাভাবে লেখা আছে ওখানকার আবিস্কারের ব্যাপারে। এজন্য আরেকটা অভিযান পরিচালনা করা হয় দক্ষিণ আমেরিকায়। ওখানে কি পাওয়া গেছে, তা অবশ্য কোথাও উল্লেখ করা নেই। তবে বলা হয়েছে- ওই মিশন নাৎসিদের পথ দেখিয়ে আনে তিব্বতে, এই সোনালি পাহাড়ে।

এখানে…

‘আমাদের হাতে আরও তথ্য থাকলে ভালো হত,’ হেনরি বলল। ‘দক্ষিণ আমেরিকায় কী পাওয়া গিয়েছিল জানলে খুশি হতাম।’

পাতা উল্টাল লরা। ‘যথেষ্ট পেয়েছি। আমাদের এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ওরা।’ ছাতাপড়া কাগজ থেকে এক লাইন পড়ল ও। ‘দুই কালো পাহাড়ের মাঝে ভোরের রোদ লেগে জ্বলজ্বল করে যে সোনার পাহাড়,’ বলে তাকাল উপরে। ‘ওখানেই পাওয়া যাবে উত্তর।’

‘আপাতত,’ শত-সহস্রবার লেখাটা পড়া থাকা সত্ত্বেও আবার পড়ল হেনরি। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে, অনুবাদে কোন ভুল হয়নি।

আসলেই হয়নি। এই সেই জায়গা।

‘তো প্রবেশপথ থাকার কথা চাঁদের পথের শেষে,’ বাইনোকুলারে চোখ রেখে ঢালটা পরীক্ষা করল হেনরি। পাথর আর তুষার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। ‘কিংবদন্তীতে সবসময় এমন ধোঁয়াশাময় নাম কেন থাকে? চাঁদের পথ… কি বুঝব এটা থেকে? চাঁদের দিকে যে পথ গিয়েছে? নাকি চাঁদ যে পথে উদয়-অস্ত যায় সেটা?’

‘আমার ধারনা হচ্ছে পথটা চাঁদের মতো দেখতে,’ লরা বলল। ‘আধখানা চাঁদ।’

‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’ হেনরির চোখে এমন কিছু ধরা পড়ছে না, যা কস্মিনকালে চাঁদের আকৃতির সাথে খাপ খায়।

‘কারণ,’ স্বামীর চোখ থেকে বাইনোকুলার সরিয়ে দিল লরা। ‘এত দূরে নয়, একদম সামনেই দেখতে পাচ্ছি ওটা।’

হেনরি চোখ পিটপিট করল। বুঝতে পারছে না স্ত্রীর কথা। অবশেষে ব্যাপারটা ধরা পড়ল তার নিজের চোখে।

সামনে বাঁকা ও সরু এক দীর্ঘ পথ উঠে গেছে চূড়ার দিকে। ডানে উঠে মিশে গেছে প্রশস্ত এক কার্নিশে। চারদিকে কালো সব পাথরখণ্ড, কিন্তু সরু ওই পথ ছেয়ে আছে সাদা তুষারে। ঠিক যেন আধাআধি চাঁদ। মাটিও অপেক্ষাকৃত মসৃণ ওখানে। আগে কেন দেখেনি, ভেবে অবাক হলো হেনরি।

‘লরা?’

‘হ্যাঁ?’

‘ভাগ্যিস তোমাকে বিয়ে করেছিলাম।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি,’ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসল ওরা। তারপর চুমু খেল। ‘তো বলো,’ আলাদা হয়ে মুখ খুলল লরা। ‘কত দূর হতে পারে ওটা?’

‘এক মাইল সম্ভবত, পাঁচশো ফুট উপরে। মাত্রাতিরিক্ত ঢালু নয়।’

‘আদ্যিকালের স্যান্ডেল পরে যদি আটলান্টিয়ানরা ওখানে উঠতে পারে, হাইকিং বুট পায়ে দিয়ে আমাদের না পারার তো কারণ নেই।’

‘আমিও তাই ভাবছি।’ পুরনো খাতাটা ব্যাকপ্যাকে ঢোকাল হেনরি। তারপর হাত নেড়ে ইশারা করল দলের বাকিদের উদ্দেশ্যে। ‘চলো সবাই, জীবনের আহ্বানে সামনে এগিয়ে যাই।’

*

যেমন মনে হয়েছিল, চলতে গিয়ে দেখা গেল পথটা তার চেয়ে কঠিন। তুষার ঢাকা জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আলগা নুড়ি। প্রতি পদে পা হড়কানোর ঝুঁকি।

যতক্ষণে কার্নিশে পৌঁছাল ওরা, ততক্ষণে সবচেয়ে উঁচু চূড়া পেরিয়ে গেছে সূর্য। ফলে ছায়া পড়েছে পূর্বদিকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দিগন্তে চোখ রাখল হেনরি, একইসাথে শেষ কয়েক কদম পেরোতে সাহায্য করছে স্ত্রীকে। উত্তর দিকে ভারী মেঘ দেখা যাচ্ছে। ওঠার সময় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি। অনেকটা নেমে গেছে তাপমাত্রা।

‘বাজে আবহাওয়া?’ লরা স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করল।

‘তুষাড়ঝড় আসছে মনে হয়।’

‘ভালো। শুরু হওয়ার আগেই পৌঁছে গেছি।’ পেছন ফিরে কার্নিশটা দেখল লরা। সবচেয়ে চিকন অংশটাও দশ-বারো গজ প্রশস্ত। ‘এখানে ক্যাম্প করলে সমস্যা হওয়ার কথা না।’

‘আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগে গাইডদের বলো তাঁবু ফেলতে,’ হেনরি বলল। সোজা পথের এখানেই সমাপ্তি। কার্নিশের পর থেকে ওঠার জন্য ক্লাইম্বিং গিয়ার লাগবে। সেটা কোন সমস্যা না। সবকিছু ওদের সাথে আছে। তবে যদি আহনেনেরবে-র কাগজপত্র সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এসবের দরকার পড়বে না…

তিব্বতিদের নির্দেশ দিয়ে স্বামীর কাছে ফিরল লরা। ‘তুমি কী করতে যাচ্ছ?’

‘একটু ঘুরে দেখি আশেপাশে। যদি গুহায় ঢোকার মতো কোন প্রবেশমুখ থাকে, খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না।’

লরা ভ্রুকুটি করল। সবুজ চোখে গভীর দৃষ্টি। ‘তাহলে ওদের তাঁবু ফেলতে বললে কেন?’

‘এজন্যই তো টাকা দিয়েছি।’ কাছের পাথরে একা বসে থাকা একজনের দিকে ফিরল হেনরি। ‘তোমার খবর কি, জ্যাক? আসতে চাও?’

দলের তৃতীয় আমেরিকান সদস্য পারকার হুডের নিচ থেকে উঁকি মারল। ‘দম ফিরে পেতে দাও একটু, হেনরি। মনে হয় আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করাই ঠিক হবে। পানি ফুটলে একটু কফি ঢালব গলায়।’

‘এই তিব্বতে এসেও ক্যাফেইনের নেশায় বাধা পড়েনি, হাহ?’ জ্যাককে পেছনে ফেলে স্বামী-স্ত্রী আগে বাড়ল। ‘এত বছর ধরে বলে আসছে, আমরা নাকি আটলান্টিস খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি। তারপর যখন ভালো একটা সূত্র পেলাম, সাথে আসার জন্য উতলা হয়ে গেল। আর অবশেষে দরজায় কড়া নাড়ছি, এমন সময় কফি বিরতি চাই!’ হেনরি বলল। কয়েক মিনিট চলার পর থামল ও। তাকিয়ে রইল সামনের পাথরের দিকে।

‘কিছু পেলে?’ লরা জানতে চাইল।

‘এই পাথরগুলো…’ সামনে ইঙ্গিত করল হেনরি। বহু বছর আগে, ইন্ডিয়ান আর এশিয়ান টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণে ভেঙেচুড়ে উপরদিকে উঁচু হয়েছে ভূখণ্ডের স্তর। ফলাফল হিসেবে জন্ম নিয়েছে হিমালয় পর্বতমালা।

‘কী হয়েছে এগুলোর?’

‘এই পাথরগুলো সরিয়ে দিতে পারলে,’ হেনরি একটা স্তূপের দিকে ইশারা করল। ‘হয়তো প্রবেশপথ পাওয়া যাবে।’

পাথরের ভাঁজে একফালি কালো অন্ধকার লক্ষ্য করল লরা। ‘ঢোকার মতো বড়?’

‘দেখা যাক,’ স্তূপের উপরের পাথর সরাতে থাকল হেনরি। ফলে বড় হলো কালো মুখ। ‘হাত লাগাও আমার সাথে।’

‘ওহ, স্থানীয়দের তাঁবু পাতার জন্য পয়সা দিচ্ছ। আর ভারী পাথর সরানোর বেলায় মনে পড়ে বউয়ের কথা…’

‘নিশ্চয়ই ভূমিধ্বস হয়েছিল। এটা প্রবেশপথের উপরদিক।’ আরও পাথর সরাতে থাকল হেনরি। লরা সাহায্য করল। ‘ফ্ল্যাশলাইট কাজে লাগাও, দেখো শেষ মাথা দেখা যায় কি না।’

ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগলাইট বের করে আনল লরা। জ্বালিয়ে তাক করল গর্তে। ‘তলা দেখতে পাচ্ছি না।’ তার চিৎকার করা কণ্ঠের প্রতিধ্বনি এল ভেতর থেকে। হেনরি চমকে উঠল। ‘ওহ, দুঃখিত।’

‘জায়গাটা বেশ বড়,’ বলে উঠল হেনরি তারপর। ‘তোমার মুখের মতো প্রায়।’

স্বামীর মাথার পেছনে আলতো হাতে চাপড় বসাল লরা।

‘এই পাথরটা সরিয়ে দিতে পারলে হয়তো কোনমতে ঢুকতে পারব।’ হেনরি বলল।

‘মানে আমি হয়তো ঢুকতে পারব।’

‘অবশ্যই, লেডিজ ফার্স্ট।’

‘এত সৌজন্য দেখাতে হবে না,’ লরা কৌতুক করল। তারপর একসাথে দু’জন মিলে আঁকড়ে ধরল পাথরটা। শুরুতে কিছু হলো না, তারপর সম্মিলিত টানের মুখে পিছু হটল ভারী প্রস্তরখণ্ড। দেখা গেল সদ্য উনুক্ত হওয়া খোলা মুখটা প্রায় তিন ফুট লম্বা, আর চওড়ায় এক ফুট।

‘ঢুকতে পারবে তো?’ হেনরি জানতে চাইল।

এক হাত ঢুকিয়ে লরা গুহার নিচটা পরখ করল। ‘ভেতরে চওড়া হয়েছে। একবার ঢুকে গেলে সমস্যা হবে না আশা করি।’ নিচু হয়ে ফ্ল্যাশলাইট তাক করল তারপর। ‘ভূমিধ্বসের ব্যাপারে তোমার কথাই ঠিক। বেশ ঢালু জায়গা।’

‘তোমার গায়ে দড়ি বেঁধে দিচ্ছি,’ ব্যাগ খুলতে খুলতে বলল হেনরি। ‘সমস্যা হলে টেনে তুলে নিতে পারব তাহলে।’

ক্লাইম্বিং হার্নেস বাঁধা হলে চুলে পনিটেইল করল লরা। তারপর পা আগে দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহায় দাঁড়ানোর পর মনে হলো যেন জুতোর নিচ থেকে সরে যাচ্ছে ঢিলে হয়ে যাওয়া নুড়ি।

‘কী দেখছ?’ হেনরি জানতে চাইল।

‘যতদূর চোখ যায় শুধু পাথর।’ আবছায়াতে লরার চোখ সয়ে আসছে আস্তে আস্তে। আবার জ্বালতে হলো ম্যাগলাইট। ‘নিচে সমতল মেঝে। মনে হয়…’ আবার লাইট উঁচু করল ও। পাথুরে দেয়ালে আলো পড়ছে। ‘এখানে একটা প্যাসেজওয়ে আছে। বেশ প্রশস্ত। জানি না কতদূর গিয়েছে। লম্বা পথ হতে পারে।’ কণ্ঠে উত্তেজনা। ‘মনে হচ্ছে মানুষের হাতে তৈরি!’

‘নিচে নামতে পারবে?’

‘চেষ্টা করছি।’ পরীক্ষামূলকভাবে এক পা আগে বাড়ল লরা। দুই হাত তুলে রেখেছে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। স্তূপ থেকে টলমল করছে আলগা পাথরের গুঁড়ো। ‘খুব নরম মনে হচ্ছে। আমাকে সম্ভবত…’

কড়মড় আওয়াজে ডান পায়ের নিচ থেকে একটা পাথরের টুকরো সরে গেল। তাল সামলাতে না পেরে পিঠে ভর দিয়ে পড়ল লরা, গড়াতে গড়াতে চলল ঢাল বেয়ে। নাচছে ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

‘লরা! লরা!’

‘আমি ঠিক আছি! পা ফসকে গিয়েছিল।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল মহিলা। মোটা কাপড় গায়ে থাকায় হাত-পা কেটে-ছড়ে যায়নি।

‘টেনে তুলে আনব নাকি?’

‘না না। ঠিক আছি আমি। চলেই যখন এসেছি, আশেপাশে দেখে যাই।’ ছিটকে পড়ে যাওয়া লাইটটা হাতে নিল লরা…

আর সাথে সাথে বুঝতে পারল, এখানে সে একা নয়।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল মহিলা। ভয়ের চেয়ে ধাক্কা খেয়েছে বেশি। তারপর মনে জায়গা করে নিল কৌতূহল। আশেপাশে আলো ফেলে দেখতে লাগল চারপাশের দৃশ্য।

‘হেনরি?’ স্বামীকে ডাকল এক মুহূর্ত পর।

‘কি?’

‘মনে আছে সেই গোপন নাৎসি অভিযানের কথা? তিব্বতে আসার পর আর তাদের কোন হদিস পায়নি কেউ।’

‘হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়।’ কৌতুকের ছলে চেঁচিয়ে জানাল হেনরি। ‘কেন?’

লরার কণ্ঠে বিজয়ের উল্লাস। ‘মনে হয় আমি ওদের খুঁজে পেয়েছি।’

*

গুহায় পাঁচটা লাশ। শীঘ্রই বোঝা গেল, পাথর ধ্বসে মৃত্যু হয়নি তাদের। সম্ভবত হিমালয়ের প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে মরেছে হতভাগারা। একই কারণে শুকিয়ে মমির মতো হয়ে আছে লাশগুলো। অভিযাত্রী দলের বাকিরা গুহা ঘুরে দেখতে দেখতে মৃতদেহগুলোর দিকে মন দিল ওয়াইল্ড দম্পতি।

‘সম্ভবত খারাপ হয়ে গিয়েছিল আবহাওয়া,’ হেনরি বলল। বৈদ্যুতিক লন্ঠনের আলোয় দেখছে লাশগুলো। ‘তাই এখানে এসে আশ্রয় নেয়। আর বাইরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।’

‘ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু, আমি কখনও এভাবে মরতে চাই না,’ লরা মুখ বিকৃত করল।

তিব্বতি গাইডদের একজন, সোনাম, প্যাসেজের সামনে থেকে ডাকল এমন সময়। ‘প্রফেসর ওয়াইল্ড! এখানে আরও কিছু আছে।’

মৃতদেহ ছেড়ে গুহা ধরে আগে বাড়ল ওরা। লরা যেমনটা ভেবেছিল, এদিকটা আসলেই মানুষের হাতে তৈরি। পাথর কুঁদে বানানো হয়েছে। ত্রিশ ফুটের মতো দূরে, দলের বাকিদের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় দেখা গেল পথের শেষ মাথায় কি আছে।

একটা মন্দির… কিংবা সমাধি।

আয়তাকার চেম্বারের মাঝখানে বেদির মতো জায়গাটা পরীক্ষা করছে জ্যাক। ‘তিব্বতি নয়,’ ওয়াইল্ড দম্পতিকে এগোতে দেখে ঘোষণা করল ও। ‘পাথরের লেখাগুলো গ্লোযেল বা এই ধরণের কোন ভাষা।’

‘গ্লোযেল?’ হেনরির গলায় বিস্ময় আর উচ্ছ্বাসের মিশ্রণ। ‘আমি সবসময় বলে আসছি, আটলান্টিয়ানরা এমন ভাষা ব্যবহার করত।’

‘কে জানে কি করত না করত।’ দেয়ালে আলো ফেলল লরা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কলামে শিলালিপি খোদাই করা। তির্যক ভাবে লেখা হয়েছে অক্ষরগুলো। দেখে মনে হয় বিশেষ কোন কারণ আছে। নাৎসিরা একেবারে জায়গামতো চলে এসেছিল, ভাবল মহিলা। অ্যালবার্ট স্পিয়ার এই স্থাপত্য অনুসরণ করত।

কলামের মধ্যে মানুষের অবয়ব আছে। সবচেয়ে বড়টার কাছে ঘেঁষল হেনরি। অন্যগুলো অপরিচিত ঠেকলেও বুঝতে বেগ পেতে হলো না এটা কার দেহাবয়ব।

‘পসেইডন…’ বিড়বিড় করল ও।

লরা যোগ দিল স্বামীর সাথে। ‘হে ঈশ্বর, এটা তো পসেইডন!’ গড়পড়তা গ্রিক কাঠামোর মতো না হলেও, আকৃতিটার ডান হাতে ধরা ত্রিশূল ভুল করার মতো নয়।

‘ভালো,’ জ্যাক বলল। ‘মি. ফ্রস্ট জেনে খুশি হবেন যে এই অভিযান সফল…’

‘ফ্রস্ট চুলায় যাক,’ লরা ঘোঁত করে উঠল। ‘এটা আমাদের আবিষ্কার। ও শুধু ফান্ড দিয়ে সাহায্য করেছে।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা,’ স্ত্রীর কাঁধে চাপড় দিল হেনরি। ‘লোকটাকে অন্তত ধন্যবাদ দিতে হবে। তার জন্যই আমাদের গাড়ি বিক্রি বা মেয়ের কলেজ ফান্ডে হাত দেয়ার সিদ্ধান্তে যেতে হয়নি।’ বলে আশেপাশে তাকাল সে। ‘সোনাম, আর কিছু আছে এখানে? কোন রুম বা প্যাসেজ?’

‘না,’ সোনাম জবাব দিল। ‘এটাই শেষ মাথা।’

‘ওহ,’ লরার হতাশ গলা। ‘এই তাহলে সব? মানে আবিষ্কারটা ভালো, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম আর কিছু…’

‘হয়তো আরও কিছু আছে,’ হেনরি সান্ত্বনা দিল। ‘কার্নিশ ধরে আরও সমাধি থাকতে পারে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।’

প্যাসেজ ধরে লাশগুলোর সামনে ফিরল সে। লরা আর জ্যাক অনুসরণ করল। নাৎসিদের পরনে অনেক বছর আগের শীতের পোষাক। শূন্য অক্ষিকোটর তাকিয়ে আছে কুঁচকানো চামড়ার ভেতর থেকে। ‘হয়তো এদের মধ্যে ক্রাউস আছে।’

‘ওই যে,’ লরা একটা লাশের দিকে ইঙ্গিত করল। ‘অভিযাত্রী দলের নেতা।’

‘তুমি কীভাবে জানলে?’

লাশটার দিকে গ্লাভপরা আঙুল উঁচু করল মহিলা। প্রায় বুক স্পর্শ করছে। লন্ঠন এগিয়ে এনে হেনরি লক্ষ্য করল, ওখানে ছোট্ট একটা ধাতব ব্যাজ আটকানো।

সাথে সাথে বরফশীতল একটা স্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া বেয়ে। শাটযস্টাফেল বা এসএস-এর ইনসিগনিয়া এটা। অর্ধশতক আগে মুছে ফেলা হয়েছে ওই সংস্থার অস্তিত্ব। তাও নামটা এখনও ভয় জাগানিয়া।

‘ইয়র্গেন ক্রাউস,’ লাশটার দিকে ঝুঁকল হেনরি। নিয়তির কি নির্মম খেল! অভিযানে এসে এসএস ইনসিগনিয়ার মতো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে নাৎসি দলনেতার নিজের করোটি। ‘কখনও ভাবিনি তোমার সাথে দেখা হবে। কিন্তু কোন সে জিনিস, যা তোমাকে এখানে টেনে আনল?’

‘খুঁজে দেখতে দোষ কি?’ লরা বলল। ‘ওই তো ওর প্যাক। ভেতরে হয়তো নোটবুক রয়েছে। দেখে নেয়া যাক।’

‘দাঁড়াও, আমাকে এই কাজ করতে বলছ?’

‘অবশ্যই। মরা নাৎসিদের জিনিসে আমি হাত দেব না।’

‘জ্যাক?’

মাথা নাড়ল জ্যাক। ‘অনেক পুরনো লাশ ঘেঁটেছি। কিন্তু এই পাপীদের ধরব না।’

‘হুশ,’ হেনরি হেসে ফেলল। তারপর হাত বাড়িয়ে আলগোছে তুলে নিল লাশের ব্যাগ, চেষ্টা করছে যথাসম্ভব কম বিরক্ত করতে।

প্রথমে বের হলো গতানুগতিক জিনিস- ফুলে ওঠা জংপড়া ব্যাটারিওয়ালা ফ্ল্যাশলাইট, গ্রিজপ্রুফ পেপারে মোড়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ ইত্যাদি। এরপর এল আগ্রহ জাগানিয়া ব্যাপার- ভাঁজ করা ম্যাপ, চামড়ায় বাঁধানো নোটবুক, গ্লোযেল লিপিওয়ালা কাগজ, ম্যাপ বা চার্ট খোদাই করা একটা তামার পাত… তারপর কালো ভেলভেটে মোড়ানো কিছু একটা।

তামার টুকরোটা হাতে নিল লরা। ‘বালুর ঘসায় ক্ষয়ে গেছে। মরোক্কোর জিনিস নাকি?’

‘হতে পারে,’ হেনরি জবাব দিল। সবার আগে নোটবুকগুলো পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু তার মন তামার পাতের উপর। এক ফুটের কম লম্বা ওটা, আশ্চর্যজনকভাবে ভারী। লন্ঠনের পাশে ওটা রেখে আলতো হাতে ভেলভেট সরাল হেনরি।

‘এটা কী?’ লরা জানতে চাইল।

‘কে জানে, ধাতব কিছু মনে হচ্ছে।’ সময় আর ঠাণ্ডার প্রকোপে শক্ত হয়ে আছে ভেলভেট। শেষ পরতটা খোলায় বেশ বেগ পেতে হলো হেনরিকে।

‘ওয়াও,’ লরার মুখ হাঁ হয়ে গেল। জ্যাকের চোখও বিস্ময়ে ছানাবড়া।

ভেলভেটের ভেতর থেকে বের হলো ইঞ্চি দুয়েক চওড়া একটা ধাতব পাত। একমাথা গোল, তীরের ফলা খোদাই করে চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে। লন্ঠনের শীতল নীলচে আলোতেও লালচে-সোনালি আভা ছড়াচ্ছে জিনিসটা। প্রকৃতিতে এমন কিছু পাওয়া অসম্ভব।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেনরি হাঁটু গেড়ে বসল ভালো করে দেখার জন্য। লরার হাতে ধরা জিনিসটাতে সময় বা আবহাওয়া কোন আঁচড় কাটতে পারেনি। যেন এই মাত্র পালিশ করে আনা। ধাতুটা সোনা বা ব্রোঞ্জ না, কিন্তু…

সামনে ঝুঁকেছে লরাও। তার নিঃশ্বাস পড়ছে ধাতুর টুকরোটার উপর। ‘আমি যা ভাবছি, এটা কি তাই?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। হে ঈশ্বর! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নাৎসিরা অরিচালকামের তৈরি আর্টিফ্যাক্ট খুঁজে পেয়েছিল, ঠিক যেমনটা বর্ণনা করে গেছেন প্লেটো। সত্যিকারের আটলান্টিয়ান আর্টিফ্যাক্ট! তাও পঞ্চাশ বছর আগে!’

‘বাড়ি ফিরে নিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও,’ লরা ফোড়ন কাটল। ‘ও সবসময় ভেবে আসছে, মরোক্কোতে পাওয়া জিনিসটা আসল অরিচালকাম।’

‘তাই করতে হবে মনে হয়,’ হেনরি সাবধানে টুকরোটা উঁচু করল। ‘এটা রঙচটা ব্রোঞ্জ হতেই পারে না।’ ও লক্ষ্য করল নিচের দিকটা সমান নয়। চৌকো অংশে বৃত্তাকার একটা ভাগ আছে। ঠিক তার উল্টোদিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে তৈরি খাঁজ। ‘বড় কিছুর অংশ হতে পারে,’ পরীক্ষা করে বলল হেনরি। ‘যেন কোথাও ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল।’

‘কিংবা দুলতো,’ লরা প্রস্তাব করল। ‘পেন্ডুলামের মতো।’

তীর চিহ্নের উপর আঙুল বোলাল হেনরি। ‘কোথাও দিকনির্দেশ করত নাকি?’

‘এই চিহ্নগুলো কীসের?’ জ্যাক জিজ্ঞেস করল। জিনিসটার দৈর্ঘ্য বরাবর সরু একটা রেখা আছে, প্রতি পাশে সারবাঁধা চিহ্ন ঝাপসা হয়ে গেছে। ছোট ছোট বিন্দু, প্রতি সারিতে আটটা করে। এছাড়াও…

‘আরও গ্লোযেল হরফ,’ হেনরি বলল। ‘কিন্তু সমাধিতে থাকা লিপির মতো না। দেখো, অনেকটা হায়ারোগ্লিফের মতো।’

আরও কাছে ঘেঁষল জ্যাক। ‘অলমেক মনে হচ্ছে, অথবা ওরকম কিছু। অগোছালো মিশ্রণ…’

‘এসবের মানে কী?’ লরা জানতে চাইল।

‘জানি না। এই ভাষায় আমি দক্ষ নই। অন্তত এখন পর্যন্ত না।’

‘মনে হচ্ছে জিনিসটা বানানোর পর যোগ করা হয়েছে লেখাগুলো,’ হেনরি যোগ করল। ‘তীর চিহ্নের তুলনায় খোদাই করা লিপি অনেক এবড়োখেবড়ো।’ জিনিসটা ভেলভেটে রাখল সে। ‘আমাদের অভিযান সফল হওয়ার প্রমাণ এটা।’ বলে জড়িয়ে ধরল লরাকে। ‘আমরা পেরেছি! প্রমাণ করতে পেরেছি, আটলান্টিস শুধু এক কাল্পনিক কিংবদন্তী নয়।’

স্বামীকে চুমু খেল লরা। ‘এবার শুধু খোদ আটলান্টিস খুঁজে বের করার পালা, তাই না?’

‘হ্যাঁ। প্রতিবার একটা করে ধাপ টপকানো।’

গুহার ভেতর থেকে চিৎকার ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করল। ‘এখানে কিছু আছে, প্রফেসর!’ সোনামের গলা।

আর্টিফ্যাক্টটা মেঝেতে রেখে তিব্বতি গাইডের সাথে যোগ দিল হেনরি ও লরা। ‘এটা দেখুন,’ সোনাম বলল। সমাধির দেয়ালে আলো তাক করে রেখেছে। ‘ভেবেছিলাম পাথরের ফাটল, তারপর বুঝলাম অন্য কাহিনী।’ এক হাতের গ্লাভ খুলে পাথুরে ফাটলে আঙুল বোলাল সে। ‘পুরোটা জুড়ে একই রকম পুরুত্ব। আর ওখানে এমন আরেকটা আছে।’ প্রায় নয় ফুট সামনে ইঙ্গিত করল তারপর।

‘দরজা?’ লরা জানতে চাইল।

ফাঁকটা অনুসরণ করল হেনরি। ফ্ল্যাশলাইটের আলো উঠে যাচ্ছে মেঝে থেকে আট ফুট উপর পর্যন্ত। ‘বেশ বড় দরজা। জ্যাককে দেখাতে হবে।’ বলে গলা উঁচু করল সে। ‘জ্যাক? কোথায় তুমি? জ্যাক!’ প্রতিধ্বনি ছাড়া কোন জবাব এল না। ‘গেল কোথায়!’

লরা মাথা নাড়ল। ‘প্রস্রাব করতে যাওয়ার আর সময় পেল না? এই শতাব্দীর সবচেয়ে আর্কিওলজিক্যাল আবিষ্কার ফেলে…’

‘প্রফেসর ওয়াইল্ড!’ অন্য এক তিব্বতি ডাকল। ‘বাইরে কিছু একটা আছে! শুনুন!’

চুপ হয়ে গেল সবাই। নিঃশ্বাস ছাড়তেও ভুলে গেছে যেন। ক্রমে কাছিয়ে আসছে ধুপ ধুপ আওয়াজ। বাতাস কাটার শব্দ এটা।

‘হেলিকপ্টার?’ লরার গলায় অবিশ্বাস। ‘এখানে?’

‘এসো,’ হেনরি ডাকল। ছুটতে শুরু করেছে প্রবেশপথের দিকে। কালো হয়ে গেছে বাইরের আকাশ। দড়ি বেয়ে উঠে গেল তারপর পাথুরে স্তূপের মাথায়।

‘চাইনিজ মিলিটারি?’ লরা জানতে চাইল।

‘ওরা কীভাবে জানবে আমরা কোথায়? এমনকি আমরা নিজেরাও তো জানতাম না শুলাওডাং ছাড়ার পর কোনদিকে যাচ্ছি।’ ফোকর পেরিয়ে কার্নিশে পা রাখল হেনরি। অনেক খারাপ হয়ে গেছে আবহাওয়া। বাতাসের তুমুল গতি…

তবে এটা তার চিন্তার প্রধান কারণ নয়। হেলিকপ্টারটা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাল হেনরি। আওয়াজ শোনা গেলেও বাহনটা চোখে পড়ছে না।

জ্যাককেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

লরা এগিয়ে এল পেছনে। ‘কোথায় ওটা?’

এক মুহূর্ত পর যান্ত্রিক ফড়িং নিজেই দৃষ্টিসীমায় উদয় হয়ে জবাব দিল প্রশ্নের।

চাইনিজ না, হেনরি সাথে সাথে বুঝতে পারল। কোন লাল তারকা চিহ্ন নেই। আসলে কোন চিহ্নই নেই। টেইল নাম্বারের জায়গাও খালি। পুরো গায়ে কালচে ধূসর রঙ স্পেশাল ফোর্সের পরিচয় বহন করছে। এরা কারা?’

বাহনটার পরিচয় বোঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান হেনরির নেই। তবে এটা পরিষ্কার, প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টে বেশ কিছু লোক আঁটবে। ককপিটের কাচের পেছনে দুই পাইলটকে দেখা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে ওরা, যেন খুঁজছে কাউকে।

ওদেরকে…

‘গুহায় ফিরে যাও!’ লরার উদ্দেশ্যে চেঁচাল হেনরি। চিন্তিত হলেও স্বামীর আদেশ মানল মহিলা। ঢুকে গেল অন্ধকারে।

কাছে চলে এসেছে হেলিকপ্টার। রোটরের বাতাসের চাপে বরফকুচি উড়ছে বাতাসে। পিছিয়ে গুহামুখে চলে এল হেনরি।

হঠাৎ এক পাইলট দেখে ফেলল ওকে, হাত তুলে ইশারা করল সঙ্গীকে দেখানোর জন্য।

বিরাট কোন এলিয়েন পতঙ্গের মতো ঘুরে গেল হেলিকপ্টার। চোখের মতো ককপিটের জানালা ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার পাশ ফিরল। একটা দরজা খুলে গেল ওদিকে। সাপের মতো দুই কয়েল দড়ি নেমে এসে পড়ল মাটিতে।

কালো কাপড়ে গা ঢাকা একজোড়া অবয়বকে দেখা গেল দড়ি বেয়ে নামতে। হেনরি লক্ষ্য করল, উভয়ে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। পিঠ থেকে ঝুলছে অটোমেটিক রাইফেল।

অভিযাত্রী দলের কাছে একমাত্র অস্ত্র বলতে আছে সাধারণ হান্টিং রাইফেল। বুনো পশু তাড়ানোর জন্য আনা। তাও সাথে থাকলে কাজ হত। জিনিসটা রেখে আসা হয়েছে নিচের ক্যাম্পে।

অস্ত্রধারীরা মাটি স্পর্শ করতে না করতে আরেক জোড়াকে দেখা গেল নামার প্রস্তুতি নিতে। ওদের পিঠেও রাইফেল ঝুলছে।

ফোকর পেরিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল হেনরি। মেঝেতে পা রাখল দুম করে।

‘হেনরি?’ ডাকল লরা। ‘কী হচ্ছে এসব?’

‘বন্ধুভাবাপন্ন মনে হচ্ছে না ওদের,’ বিরসবদনে জবাব দিল হেনরি। ‘অন্তত চারজন আছে, সাথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র।’

‘হে ঈশ্বর! জ্যাকের কী হলো?’

‘জানি না। ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমাদের ওই দরজা খুলতে হবে। এসো।’ লাশের পাস থেকে আর্টিফ্যাক্টটা তুলে নিল হেনরি। তারপর ভেলভেটে জড়িয়ে রওনা দিল সমাধির উদ্দেশ্যে।

ওদিকে চার তিব্বতি মিলে খুঁজে দেখেছে সব। ‘এখানে কিছু নেই,’ প্রফেসরকে এগোতে দেখে জানাল একজন।

‘অবশ্যই আছে,’ হেনরি চেঁচিয়ে বলল। ‘কোন রিলিজ, কি-হোল, যে কোন কিছু!’ পেছন ফিরতে দেখা গেল, একজন মানুষের ছায়া দেখা যাচ্ছে গুহামুখে। এক মুহূর্ত পর উধাও, যেন গুহা গিলে নিয়েছে। তারপর আরেকজন, আরেকজন… ‘ধুশ শালা! ভেতরে ঢুকে পড়ছে!’

লরা স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল। ‘হেনরি!’

পাঁচজন মানুষ, সবাই সশস্ত্র।

ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা।

লাল আলোর রেখা নাচছে অন্ধকারে। লেযার সাইট। পেছনে হ্যালজেন ফ্ল্যাশলাইটের বিম। আগুপিছু করে প্যাসেজ হয়ে সামনে বাড়ছে অস্ত্রধারীদের দল।

হেনরি জায়গায় জমে গেল। আলো চোখে পড়ায় সাময়িকভাবে অন্ধ। বুঝতে পারছে না কী করবে। পালানোর পথ নেই। শরীরে কাঁপতে থাকা লেযার ডট বলে দিচ্ছে, সেই চেষ্টা করতে গেলে…

‘প্রফেসর ওয়াইল্ড!’

বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল হেনরির মুখ। লোকগুলো ওর নামও জানে!

‘প্রফেসর ওয়াইল্ড?’ আবার ডাকল কণ্ঠের মালিক। ভরাট গলা। আঞ্চলিক টান আছে। গ্রিক নাকি? ‘যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আপনিও, মিসেস ওয়াইল্ড।’ ক্রমে এগিয়ে আসছে সামনে।

‘আপনারা কে?’ হেনরি জানতে চাইল। ‘কী চান?’

ফ্ল্যাশলাইট ধরা মানুষগুলো থামল। একজন এগিয়ে এল অভিযাত্রী দলের দিকে। ‘আমার নাম জিওভান্নি কোবরাস।’ সমাধিতে প্রতিফলিত হওয়া আলোর সাহায্যে লোকটার অবয়ব বুঝতে পারছে হেনরি। রোমান ধাঁচের শক্তপোক্ত, তীক্ষ্ম চেহারা। কপালের উপর থেকে কালো চুল খুলি কামড়ে পেছনে ছড়িয়ে আছে। ‘আমি যা চাই… বলতে আফসোস হচ্ছে- আপনাদের।’

লরার চোখে বিস্ময়ের দৃষ্টি। ‘মানে?’

‘মানে আপনাদেরকে আর এই অনুসন্ধান চালাতে দেয়া হবে না। মাফ চাইছি, এতে দুনিয়ার উপর কঠিন বিপর্যয় নেমে আসবে।’ মাথা নত করল কোবরাস। তারপর এক পা পিছিয়ে গেল। ‘ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ নেই আমার।’

হেনরি আর লরার উপর স্থির হলো লেযার লাইট।

কিছু বলার জন্য মুখ খুলল হেনরি। ‘দাঁড়ান…’

গুহার নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজে।

প্রতিধ্বনি থামার জন্য অপেক্ষায় রইল কোবরাস, তাকিয়ে আছে গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছয়টা লাশের দিকে। তারপর চটজলদি নির্দেশ দিল বাকিদের। ‘অভিযানের সাথে সম্পৃক্ততা আছে এমন জিনিসপত্র সরিয়ে নাও- ম্যাপ, নোট, ইত্যাদি সবকিছু। আর ওখানকার লাশগুলোর ক্ষেত্রেও একই কাজ করবে।’ বলে ইঙ্গিত করল নাৎসি মৃতদেহগুলোর দিকে। ‘ওটা সম্ভবত ক্রাউসের দল। ইতিহাসের একটা রহস্য অবশেষে সমাধান হলো।’

‘জিওভান্নি,’ এক অস্ত্রধারী ডাকল হেনরির লাশের উপর ঝুঁকে পড়ে।

‘কী হয়েছে, ইউরি?’

‘দেখো তো একটু।’

কোবরাস এগিয়ে গেল। ‘হে ঈশ্বর!’

‘এটা অরিচালকাম, তাই না? ইউরি ভোলগান জিজ্ঞেস করল। এইমাত্র মোড়ক খুলে বের করা জিনিসটার গায়ে টর্চের আলো ফেলছে। চমকাচ্ছে উজ্জ্বল কমলারঙা আর্টিফ্যাক্ট।

‘হ্যাঁ, তবে আমি আগে এমন কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্টিফ্যাক্ট নিজের চোখে দেখিনি। শুধু ভাঙাচোরা দেখেছি।’

‘সুন্দর… কপাল খুলে যাবে, কী বলো? মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হবে এটার।’

‘তা হবে,’ জিনিসটার উপর সেঁটে আছে কোবরাসের চোখ। সোজা হয়ে দাঁড়াল একটু পর। ‘তবে এটা লুকিয়ে রাখতে হবে।’ একটা ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে সমাধির দেয়াল পরীক্ষা করল অস্ত্রধারীদের দলনেতা। প্রাচীন দেবতাদের চিত্র ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ‘গ্লোযেল… তবে আটলান্টিস নিয়ে কিছু নেই।’

‘হয়তো আমাদের পুরো সমাধি খুঁজে দেখা উচিত,’ ভোলগান প্রস্তাব দিল। শেষবারের মতো দেখে নিয়ে ভেলভেটে মুড়িয়ে রাখছে প্রাচীন আর্টিফ্যাক্ট।

ভেবে দেখল কোবরাস। ‘না,’ জবাব দিল অবশেষে। ‘কিছু নেই এখানে। লুট হয়ে গেছে সম্ভবত। আমি আসলেই ভেবেছিলাম ওয়াইল্ডরা আটলান্টিসের ট্রেইল ধরে আমাদের সামনে এগিয়ে নেবে। কিন্তু এটা আরেকটা কানাগলি ছাড়া আর কিছু না। ঝড় আসার আগে বেরিয়ে যেতে হবে।’ বলে ঘুরে এগোতে শুরু করল প্রবেশপথের দিকে।

পেছনে ভোলগান ইতিউতি তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, কেউ তাকে দেখছে না। তারপর কাপড়ে মোড়া আর্টিফ্যাক্টটা চালান করে দিলে জ্যাকেটের পকেটে।

*

কার্নিশের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে কোবরাস, ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে চক্কর কাটতে থাকা হেলিকপ্টারকে সংকেত দিচ্ছে। কাজ সেরে পেছন ফিরে তাকাল ক্যাম্পের সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। ‘তুমি ঠিক কাজই করেছ।’

হুডের নিচে ঢাকা পড়েছে জ্যাকের চেহারা। ‘এজন্য আমি গর্বীত নই। ওরা আমার বন্ধু ছিল। বাচ্চা মেয়েটারই বা কী হবে?’

‘এটাই নিয়তি,’ কোবরাস জবাব দিল। ‘ব্রাদারহুড কখনও চাইবে না আটলান্টিস খুঁজে বের করা হোক। বিশেষ করে ওই ক্রিস্টিয়ান ফ্রস্ট যেন সফল না হয়। ওয়াইল্ডদের মতো অভিযাত্রীদের ফান্ড দিচ্ছে ব্যাটা। জানে আমরা নজর রাখছি তার উপর।’

‘যদি ফ্রস্ট বুঝতে পারে, আমি তোমাদের হয়ে কাজ করছি?’ জ্যাক নার্ভাস গলায় জানতে চাইল।

‘ওকে বোঝাবে পুরো ব্যাপারটা নিছক দুর্ঘটনা। শুলাওডাং-এর দশ কিলোমিটার আগে তোমাকে নামিয়ে দেব হেলিকপ্টার থেকে। এতে আমাদের সাথে কেউ দেখে ফেলার ঝুঁকি কমবে। গ্রামে ফিরে ফ্রস্টের সাথে যোগাযোগ করবে এরপর। বলবে অ্যাভালাঞ্চ থেকে তুমিই একমাত্র বেঁচে ফিরতে পেরেছ। তুষারঝড়, পাথরধ্বস… যা বলতে মন চায়।’ হাত বাড়াল কোবরাস। ‘রেডিও?’

ব্যাগ থেকে বের করে আসল মালিককে মোটাসোটা ট্রান্সমিটারটা ফিরিয়ে দিল জ্যাক। এটার মাধ্যমেই কোবরাসের দলকে সংকেত দিয়েছে। ‘আরও মানুষজনের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে। চাইনিজ কর্তৃপক্ষ, ইউএস অ্যাম্বাসি…’

‘গল্পটা পোক্তভাবে সাজাবে, তাহলেই চলবে। আমেরিকায় ফেরার সাথে সাথে পারিশ্রমিক পৌঁছে যাবে। ভবিষ্যতে কেউ ওয়াইল্ডদের পথে হাঁটতে চাইছে- টের পাওয়ামাত্র জানাবে আমাকে। ঠিক আছে?’

‘এজন্যই তো পয়সা পাচ্ছি,’ মিনমিন করে বলল বিশ্বাসঘাতক লোকটা।

শীতল হাসি দেখা গেল কোবরাসের মুখে। চলে এসেছে হেলিকপ্টার। কালো আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে নেভিগেশন লাইট।

পাঁচ মিনিট পর রওনা দিল যান্ত্রিক ফড়িং। পেছনে পড়ে রইল শুধু কয়েকটা লাশ।

 

-Andy McDermott

Translated by Adnan Ahmed Rizon

Published by Chirkut Prokashoni

The Martian- Part 1

অধ্যায় এক

লগ এন্ট্রিঃ সোল ৬

বাঁশ খেয়ে গেছি আমি।

এছাড়া আর কী বলব!

আছোলা বাঁশ।

জীবনের সেরা দুটো মাসের ষষ্ঠ দিন আজ, ভালো কাটার বদলে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।

জানি না এই রিপোর্ট কেউ পড়বে কি না। হয়তো পড়বে, আজ থেকে একশো বছর পর।

রেকর্ডে থাকার জন্য বলছি… সোল ৬-এ মরিনি আমি। তবে বাকি ক্রু-রা সম্ভবত তাই ভেবেছে। ওদের দোষ দিচ্ছি না। হয়তো আমার জন্য জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে একটা দিন, আর উইকিপিডিয়া পেইজে লেখা থাকবে- মার্ক ওয়াটনি হচ্ছে মঙ্গলে মারা যাওয়া একমাত্র মানুষ।

কথাটা সত্যিও হতে পারে। এখানে আমার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে সবার ধারণা অনুযায়ী সোল ৬-এ নয়।

দেখা যাক কী হয়… কোত্থেকে শুরু করব?

এরিস প্রোগ্রাম। মঙ্গল তথা পৃথিবীর বাইরে কোন গ্রহে মানবজাতির প্রথম পদক্ষেপ… ইত্যাদি নানা হাবিজাবি কথা। এরিস ১-এর ক্রুরা নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সেরে নায়ক সেজে ফিরেছে পৃথিবীতে। প্যারেড, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা… পেয়েছে সব।

মঙ্গলের আরেকটা জায়গায় অবতরণ করা এরিস ২-এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাড়ি ফেরার পর উষ্ণ করমর্দনের পাশাপাশি ওটার ক্রুদের কপালে জুটেছে গরম কফি।

এরিস ৩… এটা আমার মিশন। আসলে আমার না ঠিক, মিশনের দায়িত্বে কমান্ডার লুইস ছিলেন। আমি কেবল তার একজন ক্রু। সত্যি বলতে, সবচেয়ে কম কর্মক্ষম ক্রু। যদি একজনের মিশন হত এটা, তবেই কেবল দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপার সম্ভাবনা ছিল।

কিন্তু এখন? আমিই তো নেতৃত্বে।

জানি না দলের বাকি সদস্যরা বুড়ো হয়ে মরার আগে এই লগ উদ্ধার হবে কি না। আশা করি সবাই ঠিকমতো পৃথিবীতে পৌঁছাবে। বন্ধুরা, যদি এই লেখা তোমরা পাও তাহলে জেনে রেখো- তোমাদের দোষ দিচ্ছি না। যা করণীয় ছিল, তাই করেছ সবাই। তোমাদের জায়গায় থাকলে হয়তো আমিও একই কাজ করতাম। কাউকে দোষারোপ করব না, উল্টো তোমরা বেঁচে ফেরায় আমি আনন্দিত।

 

মনে হচ্ছে, মঙ্গলে আসার মিশনগুলোর ব্যাপারে একটু বলে রাখা উচিত। স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছাই আমরা। হার্মিসে আসি যে কোন একটা সাধারণ শিপে চড়ে। মঙ্গলে আসা-যাওয়ার বেলায় সব এরিস মিশনই হার্মিসকে ব্যবহার করে আসলে। আকারে বেশ বড় এই স্পেসশিপ, বানাতে খরচাও লাগে বেশ। তাই একটার বেশি বানানোর ঝক্কিতে যায়নি নাসা।

হার্মিসে ঢোকার পর, বাড়তি চারটা রোবটিক মিশনে করে ফুয়েল আর রসদ আসে আমাদের জন্য। ততদিনে আমরা যাত্রার জন্য তৈরি করতে থাকি নিজেদের। সব ঠিকঠাক থাকলে শুরু হয় মঙ্গলযাত্রা।

ভারী কেমিক্যাল ফুয়েল পোড়ানো আর ট্রান্স-মার্স ইঞ্জেকশন অরবিটের দিন ফুরিয়েছে। হার্মিস চলে আয়ন ইঞ্জিনের মাধ্যমে। শীপের পেছনদিক থেকে তীব্র বেগে আর্গন পরিচালনা করা হয়, এতে ধীরগতিতে আগে বাড়ে হার্মিস। অন্যান্য বিক্রিয়কের মতো খুব একটা ভর নেই আর্গনের। তাই ধ্রুবগতিতে চলতে থাকি আমরা এভাবে। তবে পাওয়ারের জন্য নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর কিন্তু বাদ দেয়া হয়নি।

চাইলে বলতে পারি, মিশনে কতটা মজা হয় আমাদের মাঝে। তবে এখনই ব্যাপারটা ফাঁস করতে চাইছি না। শুধু জেনে রাখুন, যাত্রাপথের ১২৪টা দিন আমরা একে অন্যের গলা টিপে ধরে রাখিনি।

পৌঁছানোর পর এমডিভি (মার্স ডিসেন্ট ভেহিকল) নিয়ে সারফেসে নামি আমরা। জিনিসটাকে বড় কোন ক্যানের সাথে তুলনা করা যায়। সাথে যুক্ত থাকে কিছু লাইট থ্রাস্টার আর প্যারাশুট। এমডিভির একমাত্র উদ্দেশ্য, ছয়জন নভোচারীকে মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে জীবিত অবস্থায় মাটির উপর নামিয়ে দেয়া।

এবার আসি অভিযানের আসল তেলেসমাতিতে। আগে থেকেই ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে সব জিনিসপত্র।

সারফেসে অপারেশন চালানোর জন্য যা যা দরকার, মোট চোদ্দটা রোবটিক মিশনে করে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয় মঙ্গলে। আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়, যেন একই অবস্থানে নামে সবগুলো জিনিস। মানুষের মতো নাজুক না হওয়ায় অবশ্য সেগুলোর ঝাঁকিহীন অবতরণ প্রক্রিয়ার দিকে অতটা নজর রাখা হয় না।

সাধারণত, সবগুলো জিনিস নিরাপদে পৌঁছেছে- নিশ্চিত হওয়ার আগে আমাদের মিশনে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। সাপ্লাই মিশনসহ এসব হাবিজাবি মিলিয়ে তাই একেকটা অভিযানে সময় লাগে প্রায় তিন বছর। এরিস ২-এর মিশন ক্রুরা যখন বাড়ি ফিরছিল, ততদিনে শুরু হয়ে গেছে এরিস ৩-এর রসদসামগ্রী পাঠানো।

এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে এমএভি বা ম্যাভ (মার্স এসেন্ট ভেহিকল)। সারফেস অপারেশন সেরে এটাতে করেই আবার হার্মিসে ফিরে আসব আমরা। তাই সবকিছুর মধ্যে এটা যেন বহাল তবিয়তে মঙ্গলে নামতে পারে, তা নিশ্চিত করা হয়। যোগাযোগ থাকে সরাসরি হিউস্টনের সাথে। যদি দেখা যায়, ম্যাভে কোন সমস্যা হয়েছে… তাহলে মঙ্গলপৃষ্ঠে অবতরণ ছাড়াই আবার ফিরতি পথ ধরার কথা আমাদের।

মঙ্গলের সারফেসে ম্যাভের কার্যপদ্ধতিও অদ্ভূত। এখানে আনা প্রতি কিলো হাইড্রোজেন দিয়ে ওটার তেরো কিলো ফুয়েল তৈরি করা যায়। প্রক্রিয়াটা বেশ মন্থর। ট্যাংক ভরতে সময় লেগে যায় প্রায় চব্বিশ মাস। এজন্য আমরা আসার অনেক আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয় ম্যাভ।

এবার ভাবুন, যখন দেখলাম- আমাকে ছাড়াই চলে গেছে জিনিসটা, কেমন হতে পারে অনুভূতি!

 

আমার প্রায় মরতে বসার ব্যাপারটা খুব আজব ছিল। বেঁচে থাকা তো আরও আজব।

একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগের বাতাস সহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল আমাদের মিশনের। তাই যখন হিউস্টন থেকে দেখল, বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় একশো পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে… তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হওয়াই স্বাভাবিক। স্পেসসুট পরে হ্যাবের ভেতর বসে ছিলাম আমরা, যাতে প্রেশার লস না হয়। কিন্তু সমস্যাটা হ্যাব নিয়ে না।

ম্যাভ আদতে একটা স্পেসশিপ। নাজুক অংশের অভাব নেই ওটার। নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে ঝড়ের মোকাবেলা করতে থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে যে কোন সময়। তাই দেড় ঘণ্টা বাতাসের প্রবল ঝাপ্টা সওয়ার পর, নাসা থেকে মিশন অ্যাবোর্ট করার নির্দেশ এলো। আমরা কেউ চাইনি, মাসখানেক লম্বা মিশন মাত্র ছয় দিনে ডিসমিস হোক। কিন্তু ম্যাভের কিছু হলে আটকা পড়ে যেতে হবে এখানে।

তাই হ্যাব থেকে বেরিয়ে ম্যাভে চড়ার জন্য রওনা হলাম। কাজটা ঝুঁকির। কিন্তু মানতে হবে, ডর কি আগে জিত হ্যায়।

সবাই সহি-সালামতেই পৌঁছে যায় গন্তব্যে, স্রেফ আমি ছাড়া।

আমাদের প্রধান স্যাটেলাইট ডিশ, যা যোগাযোগ রাখে হ্যাব থেকে হার্মিসে, বাতাসের তোড়ে একটা প্যারাশুটের মতো উড়ে এসে বাড়ি খায় রিসিপশন অ্যান্টেনায়। তারপর ভাঙা অ্যান্টেনা ছুটে এসে বুলেটের মতো গেঁথে ফেলে আমাকে।

ভাই রে ভাই, জীবনে এত ব্যথা কখনও পাইনি! মনে আছে, বাতাসের ঝাপ্টায় উল্টে পড়ে যাই সাথে সাথে। সুট থেকে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ায় কানে বাজছিল ক্রমাগত শোঁশোঁ আওয়াজ।

জ্ঞান হারানোর আগে সর্বশেষ দেখা দৃশ্য হলো, সহকর্মী জোহানসেন হতাশ ভঙ্গীতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

 

জেগে উঠলাম সুটের অক্সিজেন অ্যালার্ম শুনে। ঝড় থেমে গেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছি আমি। বালুতে প্রায় ঢাকা পড়া গোটা শরীর। সবার আগে মনে হলো এই কথাটা- শালা মরিনি কেন!

স্যুট আর আমার শরীর ভেদ করে যাওয়ার মতো যথেষ্ট গতি অ্যান্টেনার ছিল। কিন্তু পেলভিসের হাড়ে লেগে থেমে যেতে হয় বেচারাকে। ফলে একটামাত্র ছিদ্র হয়েই সন্তুষ্ট থাকে আমার স্যুট… বলা বাহুল্য, সেই সাথে শরীরটাও।

কিছুদূর গড়িয়ে এসে একটা পাহাড়ের গোড়ায় থামি আমি। উপুড় হয়ে থাকায় চাপ পড়ে অ্যান্টেনার উপর। ফলে দুর্বল একটা সিল তৈরি হয়ে স্যুটে। তারপর ক্ষত থেকে বেরোনো রক্ত এসে জমা হয় ফুটোর গোড়ায়। বাতাসের গতি আর চাপের কারণে প্রায় সাথে সাথে শুকিয়ে যায় জলীয় অংশ। ক্রমে আরও রক্ত এসে জমা হয় শুকনো অংশের পেছনে। এতে আরেকটু পোক্ত হয় গাঁথুনি।

স্যুটটা অবশ্য ওদিকে নিজের কাজ বন্ধ রাখেনি। বাতাসের চাপের তারতম্য লক্ষ্য করে ওটা আমার নাইট্রোজেন ট্যাংক থেকে ক্রমাগত শ্যূন্যস্থান পূরণ করছিল। তবে কিছুক্ষণ পর স্যুটের কার্বন ডাইঅক্সাইড অ্যাবজর্বারের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। সুরক্ষার জন্য ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাথে করে শুধু অক্সিজেন বহন করলেই হয় না, পাশাপাশি বের করে দিতে হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইডও। হ্যাবে আমাদের কাছে অক্সিজেনাটর থাকে। বিশাল এই যন্ত্রের কাজ হচ্ছে, কার্বন ডাইঅক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন ফিরিয়ে আনা। কিন্তু হালকা-পাতলা হওয়ার দরুণ স্পেসস্যুটে এই জিনিস নেই। তাই সাধারণ ফিল্টারের মাধ্যমে শোষন প্রক্রিয়া চলমান রাখা হয়। যতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম, ততক্ষণে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে আমার ফিল্টারগুলোর।

এই সমস্যা সনাক্ত করার পর প্রতিকার হিসেবে বিশেষ এক অবস্থায় চলে যায় স্যুটটা, ইঞ্জিনিয়াররা একে বলে- ব্লাডলেটিং। কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে কারিকুরি ফলানোর কোন উপায় না পেয়ে ওটা ক্রমাগত পরিবেশে দূষিত বাতাস বের করে দিতে থাকে। এবং শূণ্যস্থান পূরণ করতে থাকে নাইট্রোজেনের মাধ্যমে। সেই ট্যাঙ্ক খালি হলে ডাক পড়ে অক্সিজেনের।

আমাকে জীবিত রাখার জন্য এই কাজটাই করেছে স্পেসস্যুট। বাতাসের অভাব পূরণ করেছে বিশুদ্ধ অক্সিজেন দিয়ে। এতেও শান্তি নেই। অক্সিজেনের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে গ্যাসটা আমার স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস, চোখ ইত্যাদি বিকল করে দেবে। কী আজব কারবার দেখুন- প্রথমে ফুটোর কারণে অক্সিজেন স্বল্পতার ঝুঁকি… এরপর আবার আধিক্য!

তো এই যে এতগুলো প্রক্রিয়ার কথা বললাম, প্রতিটারই আলাদা আলাদা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার জ্ঞান ফিরল ওই অক্সিজেন অ্যালার্মে।

স্পেস মিশনের ট্রেনিং কোন হেলাফেলার বিষয় না। পৃথিবীতে প্রায় এক সপ্তাহ স্যুট নিয়ে ড্রিল করে কাটিয়েছি। জানি কি করতে হবে।

হেলমেটের পাশ থেকে সাবধানে ব্রিচ কিট খুলে নিলাম। জিনিসটা দেখতে ফানেলের মতো। এক মাথায় ছোট্ট ভাল্ভ, অন্যদিকে প্রশস্থ অংশে আঠালো রেজিন। করণীয় কাজ হলো- আপনাকে প্রথমে ভাল্ভ খোলা রেখে মোটা অংশটা জুড়ে দিতে হবে ফুটোর উপর। বাতাস ভাল্ভের মাধ্যমে বের হতে পারবে, তাই রেজিনের দিকটা স্যুটে লেগে থাকায় সমস্যা হবে না। তারপর ভাল্ভ বন্ধ করে দিলেই সমস্যার সমাধান।

আসল ঝামেলা ছিল অ্যান্টেনাটা ক্ষত থেকে সরানো। জিনিসটা আঁকড়ে ধরে টান দিলাম যত জোরে সম্ভব। হুশ করে বাতাস বেরোনোর পাশাপাশি আগুন জ্বলে উঠল যেন ক্ষতস্থানে। দেরি না করে ব্রিচ কিট দিয়ে বন্ধ করে দিলাম ফুটো। শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেল অক্সিজেন দিয়ে। হাতের স্ক্রিনে রিডআউট দেখলাম- অক্সিজেনের মাত্রা এখন ৮৫%। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ২১% থাকে সাধারণত। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হলেও বেঁচে যাব, কারণ এই অবস্থায় চিরকাল থাকতে হবে না আমাকে।

 

পাহাড় পেরিয়ে হ্যাবের দিকে এগোনোতে মন দিলাম। চূড়ায় উঠে একইসাথে ভালো আর খারাপ- দুই ধরণের অনুভূতি হলো। ভালো কারণ হ্যাবটা এখনও অক্ষত, খারাপ কারণ ম্যাভ সামনে থেকে উধাও।

বাঁশ খাওয়ার ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ নেই। তবে এটাও জানি, এখানে এভাবে মরা চলবে না। তাই পায়ে পায়ে হ্যাবে ফিরে আটকে দিলাম এয়ারলক। বাতাসের চাপ স্বাভাবিক হওয়ার পর ছুঁড়ে ফেললাম মাথার হেলমেট।

স্যুট খুলে সবার আগে মন দিলাম ক্ষতস্থানে। সেলাই লাগবে। কপাল ভালো, আমাদের সবার সাধারণ মেডিক্যাল ট্রেনিং আছে। সেই সাথে হ্যাবেও মজুদ আছে বেশ ভালো পরিমাণ মেডিক্যাল সাপ্লাই। লোকাল অ্যানেস্থেটিকের এক শট, ক্ষতস্থান পরিষ্কারের পর মোটমাট নয়টা সেলাই। কাজ শেষ। কয়েক সপ্তাহ অ্যান্টিবায়োটিকের উপর থাকতে হবে, তবে মরব না।

জানি কাজ হবে না, তাও কমিউনিকেশন অ্যারেতে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। বলা বাহুল্য, নো সিগন্যাল। প্রাইমারি স্যাটেলাইট ডিশ ভাঙা। সাথে করে নিয়ে গেছে রিসিপশন অ্যন্টেনা। হ্যাবে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি কমিউনিকেশন সিস্টেম আছে, কিন্তু ওগুলো দিয়ে শুধু ম্যাভের সাথে যোগাযোগ করা যায়। সেখান থেকে আরও শক্তিশালী সিস্টেম হয়ে সিগন্যাল পৌঁছায় হার্মিসে। তবে তার জন্য ম্যাভ কাছেপিঠে থাকা চাই।

ভাঙা যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করার একটা চেষ্টা চালানো যায়, তবে সময় লেগে যাবে কয়েক সপ্তাহ। ওদিকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মঙ্গলের কক্ষপথ ছেড়ে যাবে হার্মিস। যত দ্রুত রওনা হবে, অরবিটাল ডায়নামিক্সের কারণে তত নিরাপদ হবে যাত্রাপথ। অতএব ওদের অপেক্ষা করার প্রশ্নই আসে না।

স্যুট পরীক্ষা করে দেখলাম, আমার বায়ো-মনিটর কম্পিউটারের দফারফা করে দিয়েছে অ্যান্টেনাটা। মিশন চলাকালীন বাইরে থাকার সময়টুকুকে আমরা বলি ইভিএ বা এভা। তো এই এভা করার সময় সব ক্রু-দের স্যুটগুলো একটা নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে, যাতে একে অন্যের শারীরিক গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারে। ঝড়ের সময় হয়তো সবাই দেখেছে- আমার স্যুটের এয়ার প্রেশার শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, কম্পিউটার নষ্ট হওয়ায় বায়ো-সাইনেরও হদিস নেই। একইসাথে গড়িয়ে পড়েছি কয়েক হাত দূরে পাহাড়ের নিচে, পেটে গাঁথা বল্লম। আমাকে যে সবাই মৃত ভাববে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!

সম্ভবত লাশ উদ্ধার নিয়ে আলোচনা করেছে ওরা। কিন্তু নিয়মকানুন পরিষ্কার- মিশন চলাকালে মঙ্গলে যদি কেউ মারা যায়, তাকে ওখানেই ফেলে আসতে হবে। কারণ এতে ম্যাভে বাড়তি ওজন বইতে হবে না। ফুয়েল আর থ্রাস্টে চাপ পড়বে কম। জীবিতদের নিয়ে ঝুঁকির সামনে মৃতদের নিয়ে আবেগের দাম নেই।

 

তো এই হচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি। ফেঁসে আছি মঙ্গলে। হার্মিস বা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের উপায় নেই। সবাই ভাবছে আমি মৃত। এখন আছি এমন এক হ্যাবে, যেটা একত্রিশ দিন টেকার মতো করে বানানো।

অক্সিজেনাটর বিকল হয়ে গেলে, দম আটকে মরব। পানির ফিল্টার নষ্ট হলে, মারা যাব পিপাসায়। হ্যাব ফুটো হলে, বিস্ফোরিত হব বোমার মতো। যদি এসবের কিছু না হয়… তবুও মরব না খেতে পেয়ে।

আছোলা বাঁশ আর কাকে বলে!

 

-Andy Wier

Translated by Adnan Ahmed Rizon

Published by Rodela Prokashoni